২৬শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিদেশী চিহ্নিত ১৯ লাখ, বাংলাদেশে পুশইনের মহাপরিকল্পনা ভারতের

আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও মানবাধিকার আইনের তোয়াক্কা না করে সীমান্তে পুশইন অব্যাহত রেখেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের আসাম বিধান সভার বিরোধীদলীয় একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আসামে নাগরিক পঞ্জিতে বাদ পড়া প্রায় ১৯ লাখ বাংলাভাষীকে ‘চিহ্নিত বিদেশী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে পুশইন করার এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ভারতীয় সরকার। পুশইন করার তালিকাভুক্ত শত শত মানুষকে আসামের কমপক্ষে ছয়টি বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছে। এসব বন্দিশিবিরে গত কয়েক বছরে ২৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আসামের বিধান সভায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছাড়াও অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) নামে শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও বাংলাদেশ সরকারের লিখিত প্রতিবাদের পরও সীমান্তে অবৈধ পুশইন জোরদার করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। খোঁজ নিয়ে বাংলাদেশে ভারতের পুশইন তৎপরতার পেছনে এক ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতীয় বাংলা গণমাধ্যম সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি বিধান সভায় আসামে শত বছর থেকে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ।

তাতে বাংলাদেশে পুশইন অব্যাহত রাখার এক মহাপরিকল্পনা ফাঁস হয়েছে। তিনি জানান, সিলেট সীমান্ত দিয়ে পুশইন বেশি হওয়ার কারণ হলো মেঘালয়ে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি রেখে সিলেট বিভাগের সীমান্তজুড়ে পুশইন অব্যাহত আছে। সম্প্রতি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা রাজ্যের আইনসভায় ঘোষণা দিয়েছেন, ‘যাকেই বিদেশী হিসেবে শনাক্ত করা হবে। তাকেই সরাসরি বাংলাদেশে পুশইন করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের আইন অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না’। হিমন্ত শর্মার এমন ঘোষণার পর বাংলাদেশে পুশইন বা বন্দী শিবিরে আটকের ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন আসামের বিরোধী দলের একজন নেতা। ভারতীয় বাংলা গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে।

মেঘালয়ে কারফিউ জারি রেখে পুশইন : সিলেট সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রাত্রিকালীন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে ভারতীয় প্রশাসন। গত ৮ মে থেকে কার্যকর হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী প্রতি দিন রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ওইসব এলাকায় সাধারণ মানুষের চলাচল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, মেঘালয়ের পূর্ব ও পশ্চিম জয়ন্তিয়া হিলস, পূর্ব খাসি হিলস, দক্ষিণ গারো হিলস এবং পশ্চিম গারো হিলস জেলার সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে এই সিদ্ধান্ত গত এক মাস থেকে কার্যকর রয়েছে। সীমান্তের শূন্যরেখার ২০০ মিটার থেকে ১ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাকে ‘নিরাপত্তা সংবেদনশীল’ ঘোষণা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

সীমান্তের বাংলাদেশী অধিবাসীরা জানিয়েছেন, রাত্রিকালীন কারফিউ জারি রেখে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এরই মধ্যে নিয়মিত পুশইন করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সিলেট অঞ্চলে সবগুলো পুশইনের ঘটনা ঘটেছে গভীর রাতে অথবা ভোর বেলা।

‘চিহ্নিত বিদেশী’ ও বাংলাভাষীদের জন্য বন্দিশিবির : বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভারতের আসাম রাজ্যজুড়ে ছয়টি কারাগারের অভ্যন্তরে গড়ে তোলা হয়েছে ডিটেনশন সেন্টার বা বন্দিশিবির। এসব বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে বিদেশী চিহ্নিত বাংলাভাষীদের। আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে সম্প্রতি বন্দিশিবিরের নাম বদলে ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ করা হয়েছে। এই বন্দিশিবিরে অধিকাংশ বাংলাভাষীই ভারতীয় নাগরিক।

বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদন অনুসারে, আসামে এরকম ছয়টি বন্দিশিবির রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন সাধারণ কারাগারের অভ্যন্তরেই আছে। কর্তৃপক্ষ আটক বন্দীদের বিদেশী বলে চিহ্নিত করলেও অ্যাক্টিভিস্ট ও বন্দীদের পরিবারের দাবি তাদের বেশির ভাগই আসলে ভারতীয়।

আসামের নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষকে পুশইন করার মহাপরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। এমন পরিকল্পনার তথ্য জানিয়েছেন ভারতের কাছাড় থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি জানান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

এনআরসির রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ‘৩ কোটি এগারো লাখ ২১ হাজার ৪ জন ভারতের নাগরিক পঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন, আর ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন ওই তালিকায় স্থান পাননি। গত বছর প্রকাশিত খসড়া এনআরসি তালিকায় প্রায় ৪১ লাখ লোকের নাম বাদ পড়েছিল। তার মধ্যে প্রায় ৪ লাখ মানুষ তালিকায় নাম তোলার জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদন করেননি’।

‘অবৈধ বাংলাদেশী চিহ্নিত’ করার অভিযান : শুরুটা হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মিরের পহেলগামে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই। ভারতের নানা রাজ্যে শুরু হয় ‘অবৈধ বাংলাদেশী চিহ্নিত’ করার অভিযান। প্রথম অভিযানটা হয় গুজরাটে। গুজরাট পুলিশের সূত্রগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে যে ওই বিশেষ অভিযানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক ভারতীয় বাংলাভাষীও। শেষমেশ অবশ্য মাত্র ৪৫০ জনকে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করতে পেরেছে সেখানকার পুলিশ।

প্রায় একই সময়ে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লিতেও খোঁজা শুরু হয় যে কারা অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে বসবাস করছেন। নথি যাচাইয়ের পরে যারা ভারতীয় বলে নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছেন, তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর অন্যদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াও চলছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের আসামে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু হয় গুজরাট বা রাজস্থান অথবা দিল্লি কিংবা উত্তর প্রদেশের কিছুটা পরেই। সরকারি ভাষ্যমতে এই বিশেষ অভিযান অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতোই চালানো হয়েছে এবং যাদের আটক করা হয়েছে, তারা অনেক আগেই ‘বাংলাদেশী হিসেবে ঘোষিত’ হয়েছেন সে রাজ্যের ‘বিদেশী ট্রাইব্যুনালগুলোতে। সরকারি পরিভাষায় এরা ‘ডিক্লেয়ার্ড ফরেন ন্যাশনাল’।

আসামের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা ব্যাখ্যা দেন যে এই ‘ঘোষিত বিদেশী’রা প্রায় সবাই ভারতেরই নাগরিক, কিন্তু নামের বানানের সামান্য ভুল অথবা সঠিক নথি না দেখাতে পারার ফলে ‘বিদেশী’ বলে ঘোষিত হয়ে গেছেন। আসামের ওই বিশেষ অভিযানে কতজন আটক হয়েছেন, সেই সংখ্যা সরকার বা আসাম পুলিশ জানায়নি, তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে তাদের হিসাব মতো ৩০০’রও বেশি মানুষকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে ১৪৫ জন যে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন, সেই অভিযোগ জমা পড়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে।

ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আসামের মানুষকে যেসব নথিপত্র দেখাতে হয়, তার একটি বা দুটি না থাকলেই প্রথমে তাদেরকে ‘সন্দেহভাজন বিদেশী’ এবং পরে ‘চিহ্নিত বিদেশী’ বলে অভিহিত করা হয়। ‘চিহ্নিত বিদেশীদের’ আটক করে রাখা হয় ডিটেনশন সেন্টারে। সেগুলোর নামই এখন থেকে রাখা হচ্ছে ট্রানজিট ক্যাম্প।

বাংলাভাষীদের আটক করে রাখতে ভারতের সব থেকে বড় বন্দিশিবিরটি তৈরি হচ্ছে আসামের গোয়ালপাড়া জেলায়, যেখানে প্রায় তিন হাজার ‘চিহ্নিত বিদেশী’কে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসামের বাংলাভাষীরা। আসামের বাংলাভাষী হিন্দু মুসলমান বিশেষত প্রান্তিক মানুষ, যাদের নিজের দেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার হয়তো কোনো নথি নেই বা হারিয়ে গেছে, যার জন্য তাকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বন্দিশিবিরের নাম বদল হলেও, প্রায় সবাই বলছেন যে, তাদেরকে বন্দিশিবিরেই রাখা হবে। তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।

বন্দিশিবিরে মৃত্যু : সম্প্রতি আসামের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক অবস্থায় মারা যান দুলাল চন্দ্র পাল (৬৪)। তার বাড়ি আসামের ঢেকিয়াজুলির আলিসিঙ্গা গ্রামে। তবে নাগরিকপঞ্জিতে নাম না থাকায় বিদেশী তকমা দিয়ে তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেই মৃত্যুর প্রতিবাদে দুলাল চন্দ্র পালের পরিজন তার দেহ সৎকারে অস্বীকার করে বিক্ষোভ প্রদর্শনে বসেন। ১০ দিন চলে সেই বিক্ষোভ। তাদের দাবি ছিল, যেহেতু দুলাল পালকে বিদেশী তকমা দিয়ে বন্দিশিবিরে আটক রাখা হয়েছিল, তাই তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে তার মরদেহ পাঠিয়ে দেয়া হোক বাংলাদেশে। তার আত্মীয়-পরিজনেরা এই দেহ নেবেন না। তবে ডিটেনশন ক্যাম্পে মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনী এই একটি নয়। আছে আরো।

নাগরিক পঞ্জি প্রকাশ পাওয়ার পর আসামের তেজপুর, গোয়ালপাড়া, শিলচর, ডিব্রুগড়, কোকড়াঝাড় ও জোরহাট জেলায় ছয়টি ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয় বিদেশী তকমা পাওয়াদের। সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১১ সাল থেকে এসব বন্দিশিবিরে থাকা ২৬ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তেজপুর ও গোয়ালপাড়ার শিবিরে ১০ জন করে বন্দী মারা গেছেন। শিলচরে তিনজন, কোকড়াঝাড়ে দুইজন এবং জোরহাটে একজন মারা গেছে। তবে ডিব্রুগড় বন্দিশালায় এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। বন্দিশিবিরগুলোতে খাবারের অভাব ও কারারক্ষীদের অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে।

এক মাসে সিলেট সীমান্তে ৬০৭ জনকে পুশইন :
গত এক মাসে শুধু সিলেট বিভাগের চার জেলার সীমান্তে ৬০৭ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ। সীমান্তে বিজিবির টহল থাকা সত্ত্বেও পুশইন কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সঙ্কটের সমাধান করতে হবে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যদি ভারতের পাঠানো নাগরিকদের পুশব্যাকও করে, তাতে ঝামেলা মিটবে না। বরং মানবিক সঙ্কট তৈরি হবে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, কোনো রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে করা হয় না। ব্যক্তিদের আইনের আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগও দেয়া হয় না, যা আন্তর্জাতিক আইনের এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহুবার দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তে ‘পুশইন’ প্রক্রিয়াকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিহীন করে তোলার ঝুঁকি তৈরির কারণে তারা এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আসছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ভারতের পুশব্যাক নীতিতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয় এবং এতে মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশী সন্দেহে আটক করে প্রথমে সীমান্তে নিয়ে আসা হয়, তারপর সুযোগ বুঝে এপারে ঠেলে দেয় বিএসএফ, এই অবৈধভাবে জোরপূর্বক ঠেলে দেয়াই হচ্ছে পুশইন। এই ঠেলে দেয়া মানুষের মধ্যে অনেক ভারতীয় বাংলাভাষাভাষী নাগরিকও রয়েছেন বলে তারা মনে করছেন।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহুবার দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তে ‘পুশইন’ প্রক্রিয়াকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিহীন করে তোলার ঝুঁকি তৈরির কারণে তারা এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আসছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ভারতের পুশব্যাক নীতিতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয় এবং এতে মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশী সন্দেহে আটক করে প্রথমে সীমান্তে নিয়ে আসা হয়, তারপর সুযোগ বুঝে এপারে ঠেলে দেয় বিএসএফ, এই অবৈধভাবে জোরপূর্বক ঠেলে দেয়াই হচ্ছে পুশইন। এই ঠেলে দেয়া মানুষের মধ্যে অনেক ভারতীয় বাংলাভাষাভাষী নাগরিকও রয়েছেন বলে তারা মনে করছেন।

তথ্য মতে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে সীমান্ত দিয়ে মানুষকে ঠেলে দেয়া বা ‘পুশইন’ বাংলাদেশের জন্য নতুন সমস্যা হয়ে এসেছে, যা সমাধানে ‘পাল্টা ব্যবস্থা’ নেয়ার উপায়ও মিলছে না।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, পুশব্যাক করে আমরা পাঠাতে পারি। তাতে লাভ কী হবে? এই মানুষগুলোর কষ্ট বাড়বে। এটা তো সমাধান হলো না। এটা একটা প্রতিক্রিয়া জানানো হবে মাত্র। কাজেই এখানে কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া, আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা ভারতকে জানিয়েছি, ‘আমাদের বাংলাদেশী যদি কেউ ইন্ডিয়ায় থেকে থাকে, আপনারা প্রপার চ্যানেলে পাঠান। প্রত্যেকটার একটা প্রপার চ্যানেল আছে। যেমন ইন্ডিয়ান যারা বাংলাদেশে আছে, তাদেরও আমরা প্রপার চ্যানেলে পাঠাই। আমরা কিন্তু কাউকে পুশইন করি না। এ জন্য তাদেরও বলা হয়েছে, যদি বাংলাদেশীরা থাকে তাদের তারা প্রপার চ্যানেলে পাঠাক’।

এর আগে গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী কথিত ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ ধরতে ধরপাকড় ও অভিযান শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এর পর থেকেই ‘অবৈধ অভিবাসী’ সন্দেহে বিভিন্ন রাজ্যে গ্রেফতার বাংলাভাষাভাষীদের বিমানে করে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এর পর তাদেরকে তুলে দেয়া হচ্ছে বিএসএফের হাতে। আর বিএসএফ সময় ও সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২০ জনকে পুশইন : গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মাসুদপুর সীমান্ত দিয়ে আরো ২০ বাংলাদেশীকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গতকাল বুধবার ভোর ৫টার দিকে ওই সীমান্তে দিয়ে তাদের ঠেলে পাঠানো হয়। সীমান্তের এ পারে তাদের আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৩ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ফাহাদ মাহমুদ রিংকু এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, মাসুদপুর সীমান্তে আটকদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, সাতজন নারী ও ১০ শিশু রয়েছে। তাদের সবার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়।

বিজিবি অধিনায়ক বলেন, মাসুদপুর সীমান্ত দিয়ে ২০ জনকে পুশইন করে বিএসএফ। পরে তাদের আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তাদের সবার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফকে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, এর আগে গত ২৭ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভীষণ সীমান্ত দিয়ে ১৭ জন এবং গত ৩ জুন ভোলাহাটের চাঁনশিকারী সীমান্ত দিয়ে আট নাগরিককে পুশইন ঠেলে পাঠায় বিএসএফ।