বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, যেগুলোতে ছাত্ররা হয় নেতৃত্ব দিয়েছে, নয় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্ররা যেভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছেন, সেটি এর আগে দেখা যায়নি। বিশেষ করে ঢাকার গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে পাঁচ নেতার ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনার পর বিষয়টি জনপরিসরে এতটাই সমালোচনা তৈরি করে যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে সব শাখা কমিটি দ্রুত বাতিল করতে হয়েছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শেষ পর্যন্ত এক দফা, অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা অনেকের বিরুদ্ধেই গত এক বছরে নানা জায়গায় ক্ষমতা প্রদর্শন, হুমকি-ভয় দেখানো, চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা আদায়, সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তদবিরসহ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে হাজির হয়ে হুমকি প্রদান ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছে। তবে এবার অভিযুক্তরা হাতেনাতে ধরা পড়ায় বিষয়টি অনেকটাই ‘গুজুর-গুজুর’ ভাব কাটিয়ে প্রকাশ্যে এসেছে। তা ছাড়া, ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ গত সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শোনা গেলেও, ধরা পড়ার প্রায় সব ঘটনা ঘটে ঢাকার বাইরে। যেমন সাভার, ফেনী, রংপুরে একে একে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির ঘটনা সামনে আসে। এ বছরের এপ্রিলেও এ রকম একটি চাঁদাবাজির ঘটনায় খুলনা থেকে আটক হয় চার শিক্ষার্থী। তবে ওই সময়ে অভিযোগ থাকলেও ঢাকায় কেউ এভাবে গ্রেপ্তার হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি অভিযোগ এসেছে সংগঠনটির অধিকাংশ নেতাকর্মীর সমন্বয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপিরও কারও কারও বিরুদ্ধে। বিশেষ করে এক উদ্যোক্তা নারীর কাছ থেকে সাত লাখ টাকা নিয়েছেন এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য মো. ইমামুর রশিদ। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। তবুও পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি, বরং তিনি দাবি করেছেন, সেটি নাকি ছিল ডোনেশন বা ‘অনুদান’। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মারের বিরুদ্ধেও অনুদানের নামে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভ্যুত্থানের বষর্পূতি উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘৩৬ জুলাই: মুক্তির উৎসব’ কনসার্টের আয়োজনের জন্য ৭০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৭৬ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন সালাউদ্দিন।
বাংলাদেশে চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন এবং সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এই ধরনের চাঁদাবাজি বরাবরই করে এসেছে। সংবাদমাধ্যমে বিএনপিরও বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি করছেন বলে খবর বেরিয়েছে। বিগত ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করার, এখন বেরিয়েছে জুলাই বেনিয়া–গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে ব্যবসা।
চাঁদাবাজি একটি অপরাধ, সেটি যে দলই বা যে ব্যক্তিই করুক না কেন। কিন্তু ছাত্রদের বিশেষ করে একটি গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা কেন এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করছে? গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে যখন চাঁদাবাজি করতে গিয়ে পাঁচ তরুণ আটক হলো, তখন এই প্ল্যাটফর্মেরই একজন সাবেক সমন্বয়ক তাঁর ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ইশ! মানুষ কত নিষ্পাপ! সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো তারা আবিষ্কার করেছেন এই ছেলেগুলো আজ কীভাবে চাঁদাবাজি করল? অত্যন্ত দুঃখিত বন্ধুরা, বলতে হবে এই প্রথম কোনো চাঁদাবাজি করতে গিয়ে তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। ঠিকমত খোঁজ নিলে বুঝবেন এদের শেকড় অনেক গভীরে।’
সত্যিই, গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকটাই যেন তাদের সবাই ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে রেখেছিল। প্রধান উপদেষ্টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সকলেই বলা শুরু করলেন, ‘ছাত্ররাই আমাদের ক্ষমতায় এনেছে, চেয়ারে বসিয়েছে।’ স্বাভাবিকভাবেই নজিরবিহীন এসব ঘটনা ছাত্রদের ব্যাপক ক্ষমতায়িত করে। এরই প্রকাশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি এক ছাত্রকে বলতে শোনা গেল– ‘ছাত্ররাই আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাই আমাদের কথা শুনতে হবে।’
কী কারণে সচিবালয়ের প্রায় সব কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি রাখা হলো, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। মাঠ প্রশাসনেও ছাত্র প্রতিনিধিদের বসানো হয়। যখন ছাত্ররা জেনে গেল তারা ক্ষমতাবান, তখন থেকেই সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ‘টাকা কামানোতে’ নিজেদের যুক্ত করল। আমি হলফ করে বলতে পারি এই সমন্বয়ক এবং নেতাদের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা নিজের বিভাগে কয়জন শিক্ষক আছেন, সেটিও জানে না এবং তাদের সবার নামও জানে না। অথচ তারাই নাকি নিয়োগ দিয়েছে উপাচার্য! আমরাই ছাত্রদের এ অন্ধকার পথে ঠেলে দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়িত করতে গিয়ে তারা সেই ক্ষমতার সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়া তৈরি করছে বা করবে তা খেয়াল করিনি।
ইদানীং আবার আমরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরি ‘বৈধতা’ দেওয়ার দাওয়াই। একটি দেশে এ রকম অভ্যুত্থান হলে নাকি এ রকম কিছু ওলটপালট হবেই। একইভাবে আমরা বৈধতা দিচ্ছি মবকে কখনও ‘প্রেশার গ্রুপ’ আবার কখনও ‘তৌহিদি জনতা’ বলে, যদিও এর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল’ হিসেবে।
ছাত্রদের এই দাপুটে ক্ষমতা চর্চার আশকারা তারা নানাভাবে আমাদের কাছ থেকেই পেয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পরে সে প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে প্রধানতম হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারা যখন মব করে একের পর এক শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে তখনও আমরা কেউ কেউ বাহবা দিয়েছি। একবারও ভাবিনি এটা আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষকরা আগে দলবাজি করেছেন, এখনও করছেন। আগে একজন শিক্ষক পঞ্চাশেরও বেশি কমিটির সদস্য থাকতেন। এখনও থাকছেন। যারা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছেন, সেই তারাই পঞ্চাশের বেশি কমিটির সদস্য। হয়তো ভাবছেন কাকে ‘না করবেন,’ যোগ্য মানুষকেই সবাই চায়। কিন্তু এই সিন্ডিকেটে একবার ঢুকে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে কে কাকে কী বলবে, কেন বলবে? আমরা সবসময়ই অন্যের সংস্কার চাইছি, নিজের সংস্কার ছাড়া। জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।