৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নিউ ইয়র্কে ইতিহাস রচনা করলেন জোহরান মামদানি

নজরুল ইসলাম মিন্টো : আজকের এই ভোরটা আর পাঁচটা ভোরের মতো নয়। নিউ ইয়র্কের আকাশে সূর্য ওঠার আগে এক নতুন ইতিহাস লিখা হলো শহরের বুকে। গতকাল (২৪ জুন) রাত ১১টার দিকে ঘোষণা এলো জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্ক সিটির ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে ৫৮.৩% ভোট পেয়ে মেয়র পদে মনোনীত হয়েছেন। ৩৩ বছর বয়সী এই সমাজতান্ত্রিক প্রার্থীর বিজয় কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের জন্য এক যুগান্তকারী মাইলফলক। জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্ক রাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন এক প্রার্থী, যিনি প্রগতিশীল রাজনীতির ব্যানার উড়িয়ে পৌঁছে গেলেন শহরের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদের দোরগোড়ায়।

বিজয় উদযাপন হচ্ছিল কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে, রুজভেল্ট অ্যাভিনিউর এক হলঘরে। রঙিন আলো, পতাকার ছায়া, প্রগতিশীল স্লোগান আর চোখে জলমিশ্রিত আনন্দ সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন শতাব্দীর অপেক্ষার অবসান ঘটল।

যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনীতিতে অভিবাসী সম্প্রদায়ের দৃশ্যমান উপস্থিতি এক সময় ছিল বিরল। বিশেষ করে মুসলিম, দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের জন্য নেতৃত্বের আসনে পৌঁছানো ছিল প্রায় অসম্ভবের সমান। দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এদের অংশগ্রহণ অবহেলিত ছিল, আর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে তারা ছিলেন উপেক্ষিত। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে পরিবর্তনের যে ধারা সূচিত হয়েছে, বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদকে কেন্দ্র করে, তা এক নতুন যুগের ইঙ্গিত দেয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শাহানা হানিফ প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়ে সেই পরিবর্তনের এক দীপ্ত সূচনা ঘটান। আর ২০২৫ সালের নির্বাচনে জোহরান মামদানির বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই ধারাই যেন পূর্ণতা পেল একটি বহুস্বরের, বহুজাতিক ভবিষ্যতের নিউ ইয়র্কের প্রতিচ্ছবি হিসেবে।

জোহরান মামদানি। উগান্ডায় জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক মুসলিম। বেড়ে ওঠা নিউ ইয়র্কে। তার মা মিরা নায়ার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা (‘Salaam Bombay’, ‘Monsoon Wedding’), আর বাবা মাহমুদ মামদানি একজন বিশ্ববরেণ্য অধ্যাপক ও চিন্তাবিদ।

তিনি অ্যামহার্স্ট কলেজে ইতিহাস পড়েছেন। ২০২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক রাজ্যের অ্যাসেম্বলি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই সময়েই তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন একজন সমাজতান্ত্রিক, মুসলিম ও স্পষ্টভাষী আইনপ্রণেতা হিসেবে।

এই বছরের ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারি ছিল একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক নাটকের নাম। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি, নিউ ইয়র্কে গাজা যুদ্ধ, আবাসন সংকট, পুলিশি বর্বরতা এবং শ্রমিক অধিকার ইস্যুতে নগরবাসীর মধ্যে এক অদৃশ্য ক্ষোভ জমছিল।

জোহরান সেই ক্ষোভের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেন। তাঁর প্রচারাভিযানে ছিল ভিন্ন এক জাদু। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি তোলেন, NYPD-এর বাজেট কমানোর আহ্বান জানান, এবং সবার জন্য হাউজিং, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার স্বপ্ন দেখান।

২০২৫ সালের প্রাইমারিতে নিউ ইয়র্ক শহরের মুসলিম ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল নজিরবিহীন। বিশেষ করে কুইন্স, ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কসের বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, আরব ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ভোটারদের অভূতপূর্ব উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায়।

জোহরানের বক্তৃতায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে: “আমি কেবল মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করি না, আমি সেই সকল মানুষের পক্ষে লড়ছি, যাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।”

এই বক্তব্যেই মিলেছে এক দুর্দমনীয় শক্তি। অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ব্রুকলিনের কেনসিংটন, পার্কচেস্টারে দেখা যায় রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার, হাতে হাতে লিফলেট, সামাজিক মাধ্যমে বর্ণাঢ্য ক্যাম্পেইন।

মামদানির প্রচারণা ছিল অন্যরকম। না ছিল কর্পোরেট অর্থ, না ছিল বিলবোর্ডের বাহার। ছিল পায়ে হেঁটে ভোটারের দরজায় কড়া নাড়া, ছিল রমজান মাসে বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে ইফতারে অংশগ্রহণ, ঈদের নামাজের মাঠে শুভেচ্ছা বিনিময়; আর অংশগ্রহণ করেছেন হাই স্কুলের অডিটোরিয়ামে বিতর্ক সভায়।

তিনি কখনো বলেননি- “আমি তোমাদের হয়ে কাজ করব”। তিনি বলেছেন, “আমি তোমাদের সঙ্গে কাজ করব”। এই একাত্মতা নির্মাণই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় জয়।

নির্বাচনের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সাহসী অংশ ছিল মামদানির ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে অবস্থান। তিনি স্পষ্ট বলেন, “গাজায় যা ঘটছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আমাদের করের টাকায় যেন আর বোমা না পড়ে শিশুদের মাথায়; এই দাবি করা সন্ত্রাসবাদ নয়, মানবতা।”

এই বক্তব্য তাঁকে অনেক সমালোচনার মুখে ফেলেছিল। বিভিন্ন প্রো-ইসরায়েলি PAC তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছিল, মেইলিং চালিয়েছিল, এমনকি NYPD ইউনিয়নের একটি অংশ তাঁর প্রচারের বিরুদ্ধে খোলাখুলি কাজ করেছিল।

কিন্তু এই চাপকে জোহরান পরিণত করে ফেলেন প্রতিরোধে। তিনি বলেন, “আমাকে ধর্ম, গায়ের রং বা জাত দিয়ে নয়, আমার অবস্থান বিচার করুন ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে।”

নির্বাচনের ফল ঘোষণার রাতটি ছিল যেন এক আবেগময় গণজাগরণের মুহূর্ত। ২৪ জুন ২০২৫। রাত ১০টা ৪৭ মিনিট। নিউ ইয়র্ক সিটির রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে যায় এক নতুন অধ্যায়। তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসে: জোহরান মামদানি ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে মেয়র পদে ৫৮.৩% ভোট পেয়ে মনোনীত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, অ্যান্ড্রু কুওমো যিনি নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের প্রাক্তন গভর্নর তিনি পেয়েছেন ৩৪.৭% ভোট, আর অন্যান্য প্রার্থীরা মিলেছেন মাত্র ৭%।

এই ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কুইন্স, অ্যাস্টোরিয়া, জ্যামাইকা, ব্রুকলিনের কেনসিংটন, পার্কচেস্টার, ব্রঙ্কসের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে যেন উৎসবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। জ্যাকসন হাইটসের রাস্তায় দেখা যায় উচ্ছ্বসিত মানুষের ভিড়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে “মামদানি জিতেছে” এই বার্তা, আর তার সঙ্গে হাসি, অশ্রু, বিস্ময় আর গর্ব মিশ্র এক অনুভূতির বিস্ফোরণ।

নিউ ইয়র্কের রাত্রিকালীন আকাশে আতশবাজি না থাকলেও, বাঙালি অভিবাসীদের চোখে ছিল আলোর ঝলক। কোথাও কোথাও রেস্টুরেন্টে শুরু হয়ে যায় তাৎক্ষণিক মিষ্টি বিতরণ।

বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে ছিল প্রবল উচ্ছ্বাস; তারা মামদানিকে দেখছে এক নতুন রাজনৈতিক আইকন হিসেবে, যার পরিচয় শুধুমাত্র জাত-ধর্মে নয়, বরং মূল্যবোধে গঠিত।

একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ভোটার বলছিলেন, “আমি নিউ ইয়র্কে এসেছি ৩৫ বছর আগে। আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে, আমাদের মতো মানুষেরাও এই শহরের সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখতে পারে।”

এই জয় ছিল কেবল একজন প্রার্থীর নয়; এটি ছিল একটি অভিবাসী জাতিসত্তার, একটি প্রজন্মের, একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের বিজয়। গণতন্ত্রের এই রাত যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল নিউ ইয়র্কের প্রতিটি অলিগলিতে-“আমরাও পারি, আমরাও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অংশ নিতে পারি।”

কুইন্সে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মামদানি পেয়েছেন ৭৫% এর বেশি ভোট। বাংলাদেশি ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল ৮৬% যা গত তিন দশকে সর্বোচ্চ।

হলঘরে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে মামদানি বলেন, “আজ রাত শুধু একটি জয় নয়; আজ রাত সেই ক্ষণ, যখন আমাদের গল্প নিজেই ইতিহাস হয়ে যায়।”

জোহরান মামদানি তাঁর বিজয় ভাষণে বলেন: “আমরা এমন একটি নিউ ইয়র্ক গড়ে তুলতে চাই যেখানে কেউ রাস্তায় ঘুমায় না, কেউ ডিপোর্ট হয় না শুধু জন্মের কারণে, কেউ পেট ভরে না খেয়ে থাকে না নীতির খামতির জন্য।”

তিনি আরও বলেন: “আমার দাদি বলতেন, মাটি কখনও বেছে নেয় না কারা তার উপরে হাঁটবে। ঠিক তেমনই গণতন্ত্রও বেছে নেয় না পরিচয়, চেহারা কিংবা উচ্চারণ। গণতন্ত্র শুধু দেখে, তুমি কার পক্ষে দাঁড়াও।”

এই জয় অভিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য যেন আত্মপরিচয়ের পুনর্নির্মাণ। আজ থেকে তারা শুধু অভিবাসী নয়, তারা ক্ষমতার অংশ। বাংলাদেশি মা-বাবার সন্তানরাও এখন এই দেশের নীতিনির্ধারক হতে পারে এ বিশ্বাস নতুন প্রজন্মকে বদলে দেবে। কেউ কেউ বলছেন, “শাহানা হানিফ শুরু করেছিলেন যে অধ্যায়, মামদানি আজ তাকে পরিণতি দিলেন।”

অভিনন্দন জোহরান মামদানি! তুমি আজ প্রমাণ করেছ, অভিবাসনের গল্প কেবল কষ্ট আর সংগ্রামের নয়; এটি আশার, সম্মানের, আর নেতৃত্বে পৌঁছানোর গল্পও বটে। তুমি সেই পথ দেখালে। আজ তুমি শুধুই একজন নির্বাচিত রাজনীতিক নও, তুমি এক বিশ্বাসের প্রতীক। তোমার জয় আমাদের ভেতরকার সীমাহীন স্বপ্নকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল। টরন্টো জুন ২৫, ২০২৫ ।”নজরুল ইসলাম মিন্টো কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক ।