২৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

হোয়াইট হাউসে বলরুম নির্মাণে গুগল-অ্যাপল-মাইক্রোসফট অর্থ দিচ্ছে কেন?

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ৩০ কোটি ডলারের (প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) একটি বিলাসবহুল বলরুম নির্মাণকাজ শুরু করেছেন। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই নির্মাণকাজ হোয়াইট হাউস কমপ্লেক্সে ১৯৪৮ সালের পর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য পরিবর্তন। এ প্রকল্পের আওতায় পূর্ব দিকের উইংটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে, যেখানে এত দিন পর্যন্ত ফার্স্ট লেডির দপ্তর ছিল এবং বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে—এ নির্মাণকাজের ব্যয় সরকারি নয়, বরং বেসরকারি অনুদানে মেটানো হচ্ছে। এতে অংশ নিচ্ছে গুগল, অ্যামাজনসহ বড় বড় প্রযুক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে—এই অনুদানদাতারা কি প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রভাব বা সুবিধা পেতে পারেন?

ট্রাম্পের দাবি, ৮ হাজার ৩৬০ বর্গমিটার (৯০ হাজার বর্গফুট) আয়তনের এই বিশাল বলরুমে একসঙ্গে ৯৯৯ জন অতিথি জায়গা পাবেন। আগস্টে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছিলেন, প্রকল্পের খরচ প্রায় ২০ কোটি ডলার। কিন্তু ট্রাম্প এবার তা বাড়িয়ে ৩০ কোটি ডলার বলেছেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিলাসবহুল এ বলরুমের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে চলমান শাটডাউনে। ফলে জাতীয় রাজধানী পরিকল্পনা কমিশনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনও নেওয়া হয়নি—কারণ কমিশনটি তখন বন্ধ ছিল।

কে দিচ্ছে এই টাকা : গত সোমবার ট্রাম্প তাঁর সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন—‘১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে একটি বলরুমের স্বপ্ন দেখেছেন। আমি গর্বিত যে আমি সেই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি আমেরিকান করদাতাদের এক পয়সা ব্যয় না করে এই বহু প্রয়োজনীয় প্রকল্পটি শুরু করতে পেরেছি।’ ট্রাম্প আরও বলেন, ‘এ বলরুম নির্মাণে অর্থায়ন করছে অনেক দেশপ্রেমিক দাতা, মহান আমেরিকান কোম্পানি এবং আমি নিজেও।’

তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, কিছু অনুদান আইনি সমঝোতার অংশ হিসেবেও আসছে। যেমন, ২০২১ সালে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার পর ট্রাম্পের ইউটিউব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে ঘটনায় করা মামলার নিষ্পত্তির অংশ হিসেবে ইউটিউব ২ কোটি ২০ লাখ ডলার দেবে বলরুম নির্মাণে। ইউটিউব ও গুগল উভয়ই একই কোম্পানি অ্যালফাবেটের মালিকানাধীন।

প্রধান অনুদানদাতাদের তালিকায় কারা আছে : হোয়াইট হাউসের দেওয়া দাতাদের তালিকায় রয়েছে বেশ কিছু নামী প্রতিষ্ঠান, যাদের মধ্যে কয়েকটির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে আইনি জটিলতা বা জরিমানা হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

অ্যামাজন : যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) অভিযোগ করেছিল, অ্যামাজন অনেক ব্যবহারকারীকে তাদের অনুমতি ছাড়াই প্রাইম সদস্যপদে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মামলা নিষ্পত্তির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার জরিমানা রাজি হয়।

অ্যাপল : আইফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিটি সম্প্রতি এক আদালতের রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আদালত বলেছেন, তারা নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ ক্রয়ের ওপর কমিশন নিতে পারবে না। এ রায় বাতিলের আবেদন করেছে অ্যাপল।

কয়েনবেজ : যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ। সেপ্টেম্বরের শেষে আদালত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবসায়িক ঝুঁকি গোপন করার অভিযোগে মামলার অনুমতি দেন।

গুগল : সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ গুগলের বিরুদ্ধে অনলাইন সার্চ বাজারে একচেটিয়া আধিপত্যের মামলায় জয়লাভ করেছে।

লকহিট মার্টিন : মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রকল্পে অতিরিক্ত বিল দেখানোর অভিযোগে ২ কোটি ৯৭ লাখ ডলার জরিমানা দিতে রাজি হয়েছে।

মাইক্রোসফট : প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলা, যিনি ২০২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৯৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বেতন পেয়েছেন।

লুটনিক পরিবার : এ পরিবারের কর্তা হাওয়ার্ড লুটনিক, যিনি ট্রাম্প প্রশাসনে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর কোম্পানি ক্যান্টর গেমিং বারবার ফেডারেল আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত।

উইঙ্কলভস যমজ ভাই (ক্যামেরন ও টাইলার) : তাঁরা ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ জেমিনি ও উইঙ্কলভস ক্যাপিটালের সহপ্রতিষ্ঠাতা। সম্প্রতি ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ইউএসএসইসি) তাদের এক অবৈধ ক্রিপ্টো ঋণ প্রকল্পের মামলা নিষ্পত্তি করেছে।

আর কারা আছে তালিকায় : অন্যান্য দাতা ও করপোরেশনের মধ্যে রয়েছে: আলট্রিয়া গ্রুপ, বুজ অ্যালেন হ্যামিল্টন, ক্যাটারপিলার, কমকাস্ট, জে পেপে অ্যান্ড এমিলিয়া ফানজুল, হার্ড রক ইন্টারন্যাশনাল, এইচপি, মেটা প্ল্যাটফর্মস, মাইক্রন টেকনোলজি, নেক্সটএরা এনার্জি, প্যালান্টিয়ার টেকনোলজিস, রিপল, রেনল্ডস আমেরিকান, টি-মোবাইল, টিথার আমেরিকা, ইউনিয়ন প্যাসিফিক, অ্যাডেলসন ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন, স্টেফান ই ব্রোডি, বেটি ওল্ড জনসন ফাউন্ডেশন, চার্লস অ্যান্ড মারিসা কাসকারিলা, এডওয়ার্ড অ্যান্ড শারি গ্লেজার, হ্যারল্ড হ্যাম, বেঞ্জামিন লিওন জুনিয়র, লরা অ্যান্ড আইজ্যাক পার্লমুটার ফাউন্ডেশন, স্টিফেন এ শোয়ার্জম্যান, কনস্ট্যান্টিন সকোলভ, কেলি লোফলার অ্যান্ড জেফ স্প্রেচার ও পাওলো তিরমানি।

এই অনুদান কি আইনসম্মত : যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক আইনজীবী ব্রুস ফেইন আল-জাজিরাকে বলেন, হোয়াইট হাউসে বলরুম নির্মাণে বেসরকারি অনুদান নেওয়া অ্যান্টি ডেফিসিয়েন্সি অ্যাক্টের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই আইন অনুযায়ী, কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি পক্ষের কাছ থেকে পণ্য বা সেবা নিতে পারে না।

ফেইন উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ভাবুন তো—কংগ্রেস মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণে কোনো অর্থ দেবে না। তাহলে কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইলন মাস্ক বা অন্য কোনো বিলিয়নিয়ারের টাকায় সেই দেয়াল বানাতে পারবেন? এটি সেই একই ব্যাপার।’

ফেইন আরও সতর্ক করে বলেন, ট্রাম্প পুরোপুরি লেনদেনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বলরুমের অনুদানদাতারা ভবিষ্যতে করছাড়, গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ কিংবা ফেডারেল অপরাধে প্রেসিডেন্টের ক্ষমা—এই সুবিধাগুলো পেতে পারেন।