৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যুক্তরাষ্ট্র

‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ এ ট্রাম্পের স্বাক্ষর, সঙ্কটের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন মধ্যবিত্ত

‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ এ ট্রাম্পের স্বাক্ষর, সঙ্কটের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন মধ্যবিত্ত

যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস প্রায় ২৯ ঘণ্টার দীর্ঘ বিতর্কের পর ট্রাম্পের সেই তথাকথিত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ পাস করেছে। বিশাল কর ছাড় ও ব্যয় প্যাকেজের এই বিল যা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এজেন্ডার একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ বৃহস্পতিবার ২১৮–২১৪ ভোটে বিলটির পক্ষে রায় দেয়।

হাউসের সব ২১২ জন ডেমোক্র্যাট সদস্য বিলটির বিরোধিতা করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন কেনটাকির রিপাবলিকান প্রতিনিধি থমাস ম্যাসি এবং পেনসিলভানিয়ার ব্রায়ান ফিটজপ্যাট্রিক, যারা নিজেদের দলের অবস্থান থেকে সরে এসে বিলটির বিরুদ্ধে ভোট দেন।

বিলটি পাস হওয়ার পর প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও রিপাবলিকান নেতা মাইক জনসন তার দলের সহকর্মীদের প্রশংসা করেন। শুরু থেকেই কর সংস্কার ও অভিবাসন সংক্রান্ত এই বিলটি নিয়ে আপত্তি ছিল দেশটির বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির। ট্রাম্পের নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির কেউ কেউও বিলটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তবে ভোটের ফল বলছে, চার ভোটের ব্যবধানে বিলটি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় করেছে। অবশ্য, বর্তমানে মার্কিন আইনসভার দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ট্রাম্পের দল।

বিলটি হাউসে পাশ হওয়ার পরে উচ্ছ্বাস গোপন করেননি ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিলে সই করতে চলেছি। এটা দেশকে রকেট গতির উন্নতিতে পৌঁছে দেবে। দারুণ ব্যাপার হতে চলেছে।’ ৪ঠা জুলাই শুক্রবার ভোরে তাতে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ঘটনাচক্রে, এ দিনটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস।

ট্রাম্প ইতিমধ্যে তার দলের আইনপ্রণেতাদের ৪ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের আগেই বিলটি পাস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিলটিতে যেমন কর সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তেমনই প্রতিরক্ষা খাতে, বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসী হটানোর কাজে বড় অঙ্কের টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। বিল পাশ হওয়ার পর ট্রাম্প নিজেও দাবি করেছেন, আমেরিকার সুরক্ষার জন্য এটা বড় পদক্ষেপ।

বিলে নিম্ন আয়ের ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ফেডারেল স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি থেকে বিপুল অর্থ ছাঁটাইয়ের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যেই বিলটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে আমেরিকাজুড়ে।

নতুন আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের সীমা অর্থাৎ ফেডারেল সরকার যতটুকু ঋণ নিতে পারবে— তা ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়ানো হবে। এছাড়া বিলটি অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে কয়েক দশক বিলিয়ন ডলার ব্যয় বরাদ্দ করেছে এবং ২০১৭ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে গৃহীত কর ছাড় স্থায়ীভাবে কার্যকর করবে।

এই ব্যয়ের অর্থ জোগাতে বিলটি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি মেডিকএইড এবং ফুড স্ট্যাম্প নামে পরিচিত নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি এসএনএপি–এর মতো সামাজিক কর্মসূচিগুলোতে কাটছাঁট করবে।

অরাজনৈতিক কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের হিসাব অনুযায়ী, নতুন এই বিলের ফলে আগামী ১০ বছরে আরও ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যবিমা থেকে বঞ্চিত হবেন।
তারা আরও পূর্বাভাস দিয়েছে এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি প্রায় ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে।

ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতারা বিলটিকে দরিদ্রদের সম্পদ ধনী মানুষের কাছে হস্তান্তর করার উদ্যোগ বলে সমালোচনা করেছেন, কারণ এই করছাড় মূলত উচ্চ আয়ের মানুষদের বেশি উপকার করবে।
অন্যদিকে ট্রাম্পসহ রিপাবলিকান সমর্থকরা বলছেন, এই বিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে এবং মেডিকএইডের মতো কর্মসূচিতে অপচয় ও জালিয়াতি কমাবে।

দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নেমে নির্বাচনি প্রচারে বারবার এই বিলের কথা বলেছেন ট্রাম্প। জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলেই তিনি এই বিল বাস্তবায়ন করবেন। অবশেষে পাস হলো সেই বিল। স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা খাতে ব্যয় সংকোচ করার পাশাপাশি এই বিলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং অভিবাবসন প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ব্যাপারেও এই বিলে বিপুল অর্থ ধার্য করা হয়েছে। পাশাপাশি সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে এই বিলে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই বিলে সেই সিদ্ধান্তগুলোকে রদ করে দিচ্ছে।

অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধের যে প্রকল্প ট্রাম্প গ্রহণ করেছেন, তাতে ব্যয় করা হবে ১৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মেক্সিকোয় সীমান্ত পাঁচিল তৈরিতেও এই অর্থ খরচ হবে বলে জানানো হয়েছে। সীমান্তে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও জানিয়েছেন ট্রাম্প। সামরিক খাতে ব্যয় করা হবে ১৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে মিসাইল এবং যুদ্ধ জাহাজ তৈরিতে। পরমাণু অস্ত্র তৈরিতেও বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করা হবে বলে জানা গেছে।

তবে পরিবেশবিদেরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে। প্রচারে ট্রাম্প একটি কথা বারবার বলেছেন, ‘ড্রিল বেবি ড্রিল’। অর্থাৎ, নতুন করে খনিজ তেল উত্তোলন শুরু করতে হবে। এই বিলে সেই খাতে ব্যয় ধার্য করা হয়েছে। তোলা হবে প্রাকৃতিক গ্যাসও। এর আগে বিকল্প শক্তির জন্য সরকার যে অর্থ ব্যয় করেছিল, তা বদলে দেওয়ার নীতি নিয়েছেন ট্রাম্প। ইলেকট্রিক গাড়িতে ছাড় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

কী আছে বিলে?
১. কর হ্রাস: এই বিলের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি ও বড় কর্পোরেটদের জন্য আয়কর কমানো হয়েছে। ২০১৭ সালে ট্রাম্পের আমলে যে কর ছাড় আইন পাস হয়েছিল, এটি সে আইনের স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। টিপস, ওভারটাইম ও ব্যবসা খাতের গবেষণা ও উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি)-এ ২০২৮ সাল পর্যন্ত কিছু অস্থায়ী কর ছাড় আনা হয়েছে। স্টেট ও লোকাল ট্যাক্স ডিডাকশনের সীমা অস্থায়ীভাবে ৪০ হাজার ডলার করা হয়েছে। এতে উচ্চ করের রাজ্যগুলোতে বসবাসকারী ধনীরা উপকৃত হবে। চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট আরও ২০০ ডলার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

২. অভিবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ছে কঠোরতা : প্রস্তাবিত বিলটিতে সীমান্ত অবকাঠামো সম্প্রসারণের জন্য ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বিলের আওতায় ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে ১ লাখ অতিরিক্ত শয্যা যুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি আরও ১০ হাজার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) অফিসার নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়াও সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টাকারী বা আশ্রয় সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের জন্য নতুন জরিমানা ও শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

৩. কমছে ক্লিন এনার্জি ও বৈদ্যুতিক গাড়ির বরাদ্দ : বাইডেন প্রশাসনের ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ থেকে ক্লিন এনার্জি প্রণোদনা বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ ছাড়া, বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) জন্য ৭ হাজার ৫০০ ডলারের কর ছাড় ২০২৫ সালের পর ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করা হবে। ২০২৮ সালের আগে নির্মিত না হলে নতুন উইন্ড ও সোলার প্রকল্পে কোনো কর ছাড় দেওয়া হবে না। এর বদলে, কয়লা উৎপাদনে নতুন কর ছাড় চালু করা হয়েছে।

৪. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে করাঘাত : মেডিকেইড ও এসএনএপি (ফুড স্ট্যাম্প) কর্মসূচির অর্থায়নে বড় ধরনের ছাঁটাই করা হয়েছে। ৬৫ বছরের নিচের কর্মক্ষম, কিন্তু সন্তানহীন ব্যক্তিদের জন্য কঠোর কর্মসংস্থান শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য বীমা হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রাম এলাকার হাসপাতালগুলোর সহায়তায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের একটি ফান্ড তৈরি করা হয়েছে। তবে সমালোচকেরা বলছেন, এই তহবিল সামগ্রিক ক্ষতির সিকিভাগও নয়।

৫. নারীস্বাস্থ্য : পরিকল্পিত সন্তান ধারণের সহায়তায় যে ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেল তহবিল’ ছিল তা এক বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ এই কার্যক্রমের মাধ্যমে গর্ভপাতকে অনুপ্রাণিত করা হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের আগে থেকেই এই ধারণা নিয়ে রেখেছিল।

৬. প্রতিরক্ষা, মহাকাশ ও অন্যান্য খাতে ব্যয় : এই বিলে প্রতিরক্ষা খাতে ১৫০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, যার মধ্যে ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য বরাদ্দ ২৫ বিলিয়ন ডলার। আর মহাকাশ গবেষণায় ১০ বিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) কার্যকারিতা শেষ হলে একে ৩২৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এছাড়াও, বিলটিতে নবজাতকদের জন্য ‘ট্রাম্প অ্যাকাউন্টস’ নামে একটি নতুন ১ হাজার ডলারের সঞ্চয় কর্মসূচি চালু করার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এনডোউমেন্টের (স্থায়ী তহবিল) ওপর নতুন করে কর দিতে হবে।

৭. ঋণসীমা বৃদ্ধি : এই বাড়তি ব্যয়ের খরচ মেটাতে জাতীয় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৫ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটি আর্থিকভাবে রক্ষণশীল রাজনীতিবিদদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে, কারণ এতে জাতীয় ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে।

ট্রাম্পের এই বিগ বিউটিফুল বিল থেকে সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরা ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। আর অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মনরক্ষা করবে এই বিল। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের পরিবার, সামাজিক নিরাপত্তা থেকে পাওয়া প্রণোদনার ওপর নির্ভরশীল নাগরিকেরা পড়বেন বেকায়দায়। আর অভিবাসন প্রার্থীরা ও সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থীরা এরইমধ্যে ট্রাম্পের কঠোর সীমান্ত নীতির মুখোমুখি হয়ে পড়েছেন।