২৫শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ড. ইউনূসের আমলে কতটা দুর্নীতি, কেমন উদ্যোগ দমনের?

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসে তাতে কতটা পরিবর্তন এসেছে?
বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, আগে সরকারের সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সব জায়গায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা মিলে একটা দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। তবে এখনো দুর্নীতি যথেষ্টই আছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতিকে প্রোমোট করছে এমনটি নয়। তারা মনে করেন, এখন বিচ্ছিন্নভাবে দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতি রয়ে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতাও দেখা যাচ্ছে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে এনসিটিবিতে কাগজ সরবরাহে ৪০০ কোটি টাকা কমিশন নেয়ার অভিযোগ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া ডিসি নিয়োগে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠার পর তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সাবেক দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবী ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও তদবির বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। তাদের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে কারো বিরুদ্ধেই এখনো মামলা হয়নি।

গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের দুর্নীতিতে জড়ানোর বিষয়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার আনোয়ারুল ইসলাম। ডয়চে ভেলেকে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সচিবালয়ে একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে বিভিন্ন কর্মকর্তার রুমে ঘুরে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীর। তখন তার তদবির নিয়ে একটা রিপোর্ট করি। এ নিয়ে তখন আমাকে নানা ধরনের চাপ সহ্য করতে হয়েছে। কারণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তখন কেউ কারো দায় নিতে রাজি হয়নি। যাই হোক পরিস্থিতি সামলেছি। পরে তো দেখা গেল এই ব্যক্তি আরো বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন তো অনেক জায়গায় তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হচ্ছে।”

গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তিনি পরিস্থতির শিকার। দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আক্তার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।” যেসব উপদেষ্টার পিও বা এপিএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেই উপদেষ্টাদের তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একটা অভিযোগের তদন্ত যখন হয়, তখন এর সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা মেলে, তাদের সবাইকেই মামলার আসামি করা হয়। ফলে বিষয়টির এখন তদন্ত হচ্ছে। যদি কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের সবাইকেই মামলায় আসামি করা হবে।”

এনসিপির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : শুধু কি গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ? এমন অভিযোগ আরো অনেক নেতার বিরুদ্ধেই। নিজ এলাকায় এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের শতাধিক গাড়ির বহরের মহড়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তার দলেরই আরেক নেতা ডা. তাসনিম জারা। সারজিস আলম ওই প্রশ্নের জবাবে তখন গাড়িগুলো তার আত্মীয়-স্বজনরা দিয়েছেন বলে দাবি করেন। গাড়ি ব্যবহার বিষয়ক আরেক সমালোচনার জবাবে আব্দুল হান্নান মাসউদ দাবি করেছেন, তার বিলাসবহুল গাড়িটি জামায়াতের এক ব্যবসায়ী নেতা তাকে দিয়েছেন। এনসিপি আত্মপ্রকাশের দিন মানিক মিয়া এভিনিউতে জমকালো সমাবেশ এবং পাঁচতারা হোটেলে দলটির ইফতার পার্টিতে খরচের উৎস নিয়েও প্রশ্ন আছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দল চালাতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ‘ডোনেশন’ নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে তারা কত টাকা নিয়েছেন এবং কাদের কাছ থেকে নিয়েছেন তা এখনো প্রকাশ করেননি। এছাড়া কয়েকজন নেতার বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার, রাতারাতি জীবনধারার পরিবর্তন, হেলকিপ্টারে ভ্রমণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

রেল ভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি)-র একান্ত সচিবের কক্ষে তদবির করার অভিযোগ ওঠে এনসিপির সংগঠক (হবিগঞ্জ) নাহিদ উদ্দিন তারেকের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। ভিডিওতে তারেকের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সিনথিয়া জাহিন আয়েশাকেও দেখা গেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সাবেক সহকারি একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তারা সরাসরি এনসিপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও এনসিপি সমর্থিত হিসেবে পরিচিত। তাদের এসব অভিযোগও এনসিপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ওয়াসার আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগে সুপারিশ নিয়ে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুমকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক। আওয়ামী লীগের পলাতম নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে মামলা করে এরপর অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মানিকগঞ্জ জেলার যুগ্ম সদস্যসচিব মেহেরাব খান ও আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা এই নীতিতে অটল আছি যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধে যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে, সেজন্য আমাদের একটা শৃঙ্খলা কমিটি করা আছে। ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে আমরা যেটা বলছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, সেখানে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে সেজন্য সংস্কার করতে হবে। এই সংস্কারের পক্ষে আমরা কথা বলছি। মাঠ পর্যায়ে যে দুর্নীতি হয়, সেটার যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় এবং বিচার হয় সেই কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। আরেকটা বিষয়, আমরা দল গঠনের আগে থেকেই অনেক বেশি প্রোপাগান্ডার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে আমরা চাই কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া

বিএনপির বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ : দল থেকে বহিষ্কার, মামলা করেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের একাংশকে দখল, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, মামলা বাণিজ্যের মতো অপকর্ম থেকে ফেরানো যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা বিএনপি নেতা-কর্মীদের ইঙ্গিত করে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়ানোর কথা বললেও কাউকে ধরছে না পুলিশ। শাস্তির ক্ষেত্রে বিএনপিতেও দেখা যাচ্ছে দ্বৈতনীতি। তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ পাওয়ামাত্র সাজা দিলেও প্রভাবশালী অনেকের ক্ষেত্রে তেমনটা হচ্ছে না। আবার কিছু ক্ষেত্রে দলীয় কোন্দলে নেতারা একে অপরকে অপবাদও দিচ্ছেন।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, মামলা বাণিজ্যের অসংখ্য অভিযোগ আসে। ভাবমূর্তি রক্ষায় কঠোর হয় বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিকবার হুঁশিয়ারিও দেন। বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে প্রায় দেড় হাজার নেতাকে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আরো প্রায় দেড় হাজার নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনও শত শত নেতা-কর্মীকে শাস্তি দিয়েছে।

দখল ও চাঁদাবাজির মামলা হলেও দলে যারা প্রভাবশালী, তাদের শাস্তি হয়নি। অভিযোগ আসার পর ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটিই বিলুপ্ত করে দেয় বিএনপি। তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের কিছুই হয়নি। এ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এস আলমের পক্ষ নিয়ে ইসলামী ব্যাংক দখলের চেষ্টার পর ১০ ডিসেম্বর অস্ত্রসহ তার ১৭ থেকে ১৮ অনুসারীকে নিয়ে তিনি পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি কার্যালয়ে যান। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ধরে খুঁজতে থাকে তারা। এ ঘটনায় কোম্পানি কর্মকর্তা মহিবুল্লাহ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, চাঁদা না দেওয়ায় ভাঙচুর চালানো হয়, টাকা ও মোবাইল ফোন লুট করা হয়। হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তদন্ত কমিটি করে যুবদল দক্ষিণ। কিন্তু রবিউল ইসলাম নয়নের কিছুই হয়নি।

২-২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কয়রা বাজারের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন বাবুলসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। তেরখাদায় হাসান আল মামুন নামে এক ব্যক্তিকে মারধর করে ১৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করায় উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবু মোল্লা, সদস্য ফেরদৌস মেম্বার, গাউস মোল্লা ও রবিউল ইসলাম লাকুকে শোকজ করা হয়। ৪ নভেম্বর তেরখাদায় ২০৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন উপজেলা বিএনপির সদস্য আজিজুল হাকিম। এই মামলাকে ব্যবহার করেও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বগুড়ায় দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে অর্ধশত নেতা-কর্মীকে। তারপরও অনেক নেতা-কর্মী বেপরোয়া। শহরের চারমাথা এলাকায় সড়ক ও জনপদের কোটি টাকার জমি দখল করে ১৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সাজেদুর রহমান সাজু দলীয় সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। ঠনঠনিয়া এলাকায় ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে সরকারি জমিতে দোকান করে ভাড়া দিয়েছেন ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর, বিএনপি নেতা এনামুল হক সুমন। তিনি বাসস্ট্যান্ডের চাঁদার টাকাও নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বগুড়া বিআরটিএ অফিস নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে উপপরিচালকের কক্ষের ভেতরে এক উপসহকারী প্রকৌশলীকে মারধর করেন জেলা বিএনপির সহকোষাধ্যক্ষ আব্দুল জলিল বাকি। এর ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা সঠিক তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি এখনো চলমান আছে এবং থাকবে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে নেতৃত্ব পর্যায়ের সবাই কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছেন।” এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না- বিষয়টি এমন নয়। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপপ্রচারও আছে। যারা পেশাদার চোর, ডাকাত, চাঁদাবাজ তারা কি এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে? কোথাও কিছু হলে একটি মহল বিএনপির উপর দোষ চাপাচ্ছে। সঠিক তথ্য পেলে আমরা দল থেকে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতিমধ্যে অনেক নেতাকে বহিস্কার করা হয়েছে। আমরা তো শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাংলাদেশ চাচ্ছি। আওয়ামী লীগের মতো কিছু হোক সেটা তো আমরা কেউ চাই না। তবে মনে রাখতে হবে, প্রশাসনিক ক্ষমতা কিন্তু আমাদের হাতে নেই। ফলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

৫ আগস্টের পর আরো বেড়েছে?
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ গত ডিসেম্বরে প্রেস বিফিং করে বলেছিলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫ আগস্টের পর ঘুস-দুর্নীতি আরো বেড়েছে। জেলার কাস্টমস, রাজস্ব, এসিল্যান্ড ও রেজিস্ট্রি অফিসসহ প্রশাসনের বিভিন্ন অফিসে এমন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ৫ আগস্ট অনেক রক্ত, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর এ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আগামী নিয়ে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল, সে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা হতাশাগ্রস্ত। আমাদের জেলায় ৫ তারিখের পর যে ঘুস-দুর্নীতি বন্ধ হওয়া উচিত ছিল, তা বন্ধ হয়নি। কাস্টমস, রাজস্ব, এসি ল্যান্ড ও রেজিস্ট্রি অফিসসহ প্রশাসনের বিভিন্ন অফিসে আমরা লক্ষ্য করেছি, আগের তুলনায় ঘুস দুর্নীতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এত রক্তক্ষয়, এত ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এ অর্জনকে যারা এই ঘুস-দুর্নীতি দিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে একত্রিত হতে হবে।”

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বৃহস্পতিবার আব্দুল ওয়াহেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এখন একটু পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করায় অনেক জায়গায় অবস্থা বদলেছে। আবার অনেক জায়গায় আগের মতো আছে।”

বিশ্লেষকরা যা মনে করেন : ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০ মাসে দুর্নীতি বা চাঁদাবাজির চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এটা তুলনা করা যাবে না। তবে আমরা যেটা দেখেছি, ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই সারা দেশে দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, মামলা বাণিজ্য চলছে। অন্যদিকে প্রশাসনে পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল সেটার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেনি, সেটা পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। আমার খুবই সন্দেহ আছে বা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি নেই যে, আমাদের রাজনৈতিক শক্তি ও আমলাতান্ত্রিক শক্তি আন্দোলনের যে মূল চেতনা তার থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত আমি দেখতে পাইনি।”

দুর্নীতি, চাঁদাবাজির বিষয়ে গত ১০ মাসে কতটা পরিবর্তন এসেছে? জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “একটা বেসিক পরিবর্তন আছে। আগে সরকারের সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সব জায়গায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা মিলে একটা দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। তখন লুটপাটই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। একটা মাফিয়া আমলে যেটা হয়। তারা সেটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করেছিল। এখনো দুর্নীতি যথেষ্টই আছে। তবে এই সরকার দুর্নীতিকে প্রোমোট করছে- এমনটি কিন্তু না। সমাজেও কিন্তু এই পারসেপশন নেই। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতি রয়ে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে। মধ্য থেকে নিম্ন পর্যায়ে এটা রয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সরকার একটা রোল প্লে করবে, সেটা কিন্তু করছে না। এখানে আন্তরিকতারও অভাব আছে। একটা উদাহরণ দেই, একজন উপদেষ্টার এপিএস এবং একজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলো। তাদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। দুদক তদন্তও করছে। কিন্তু উপদেষ্টাদেরও এই তদন্তের আওতায় আনার যে বিষয়টি, সেটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। আমি বলছি না, যে তারা এর সঙ্গে যুক্ত আছেন। তারপরও সরকারের যেটা করা উচিত তাদেরও তদন্তের মধ্যে আনা। সেটা হচ্ছে না। এগুলো করা হলেও আমরা বুঝতাম, সরকার কিছু একটা করছে৷ সেটাও তো দেখা যাচ্ছে না। এই জায়গাটায় আগের সঙ্গে খানিকটা মিল আছে।” – সমীর কুমার দে জার্মান বেতার ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷