২৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সাংবাদিকতা কি এখন অনেক সহজ?

সাংবাদিকতা কি অনেক সহজ হয়েছে? অনেকে বলে- হ্যাঁ। এখন তো হাতে হাতে স্মার্টফোন। ক্যামেরা আছে, ইন্টারনেট আছে। মুহূর্তেই ছবি তোলা যায়, ভিডিও বানানো যায়, আবার সেটি প্রকাশও করা যায়।

ফেসবুকে পোস্ট করো, ইউটিউবে আপলোড করো, টুইটারে ছড়িয়ে দাও, খবর মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। তাহলে কি সাংবাদিকতা অনেক সহজ হয়ে গেছে? আমার মনে হয় না। বরং দিন দিন সাংবাদিকতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে।

একবার এক তরুণ সাংবাদিক আমাকে বলছিল- ‘ভাইয়া, আমি ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখলাম। সবাই লিখছে ঘটনাটা ঢাকায় ঘটেছে। আমি যাচাই করতে গিয়ে দেখি, ওটা আসলে ভারতের পুরনো ঘটনা।’ এই ঘটনা আসলে একটা নয়, মিয়ানমারের ছবি, ভারতের পুরনো ছবি ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হয়। স্কিন টোন আর পোশাকের সংস্কৃতি কাছাকাছি হওয়ায় অনেক সময় বোঝাও যায় না যে, আসলে কোন স্থানের ঘটনা এটি। এই পরিস্থিতিই বোঝায় আসল চ্যালেঞ্জ কোথায়। তথ্য এখন আর কারও একার হাতে নেই। প্রত্যেকে তথ্য তৈরি করছে, ছড়াচ্ছে। সত্যি আর মিথ্যা একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে এই বিশাল সমুদ্রে। কে সাংবাদিক, কে শুধু ব্যবহারকারী সেই সীমানা বোঝা কঠিন।

আগে সাংবাদিকতার মানে ছিল খবর সংগ্রহ করা, যাচাই করা, লেখা, তারপর ছাপা কাগজে বা টিভি পর্দায় প্রচার। এখনকার সাংবাদিককে শুধু রিপোর্ট বানালেই হয় না। তাকে হতে হয় যাচাইকারক। তাকে জানতে হয় ডেটা, অ্যালগরিদম, ফ্যাক্ট-চেকিং। তাকে বুঝতে হয় যে কোনো তথ্যের উৎস কোথায়, সেটি সত্যি না গুজব।

আমরা করোনার সময় দেখেছি- ভুয়া খবর কত ভয়ংকর হতে পারে। কারও মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা খবর, চিকিৎসাসংক্রান্ত ভুল তথ্য কিংবা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুতগতিতে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, আতঙ্কিত হয়েছে। এই ভুয়া খবর ঠেকাতে সাংবাদিকদের ঘাম ঝরাতে হয়েছে। অর্থাৎ সংবাদ ছড়ানো হয়তো সহজ, কিন্তু সংবাদ যাচাই আজ সবচেয়ে কঠিন কাজ।

আজকের সাংবাদিককে শুধু কলম ধরতে জানলেই হয় না। ক্যামেরা চালাতে হয়, ভিডিও এডিট করতে হয়, লাইভ করতে হয়, অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে হয়। আগে রিপোর্টার রিপোর্ট করত, আলাদা ফটোগ্রাফার ছবি তুলত, ভিডিও করত ক্যামেরাপার্সন। এখন এক সাংবাদিককেই অনেক সময় এই তিন-চারটা কাজ একসঙ্গে করতে হয়।

তারপর আছে প্রতিযোগিতা যে, কে কার আগে দিতে পারে। আগে প্রিন্ট নিউজে একদিন দেরি হলে তেমন ক্ষতি হতো না। এখন দেরি মানেই আপনি পিছিয়ে পড়লেন। এই চাপ সামলানো সহজ নয়।

তাই সাংবাদিকতা সহজ হয়েছে বলার সুযোগ নেই আসলে। সংবাদ ছড়ানো হয়তো সহজ। স্মার্টফোন হাতে এখন সবাই সাংবাদিক হতে চায়। কেউ দুর্ঘটনার ছবি তুলে ফেসবুকে দিলেই তা ভাইরাল হয়। কিন্তু সাংবাদিকতা কেবল ছবি বা ভিডিও দেওয়া নয়। সাংবাদিকতা মানে প্রেক্ষাপট দেওয়া, ঘটনার কারণ-পরিণতি খুঁজে বের করা এবং সবচেয়ে বড় কথা- সত্য যাচাই করা।

একজন ব্যবহারকারীর ভুল হলে সেটা ‘একজনের ভুল’ হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু একজন সাংবাদিক ভুল করলে সেটি পুরো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই পেশাদার সাংবাদিকের দায়িত্ব অনেক বেশি।

আজ আমরা ‘ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার’ বা তথ্যযুদ্ধের যুগে বাস করছি। ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হচ্ছে, করপোরেট স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে, আবার কখনও কখনও জাতিগত বা ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিককে শুধু রিপোর্টার হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। তিনি এক অর্থে সৈনিক- সত্যের সৈনিক। তার হাতে অস্ত্র কলম, ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। শত্রু হলো ভুয়া খবর, বিভ্রান্তি আর অর্ধসত্য। এই যুদ্ধ লড়াই করাই সাংবাদিকতার মূল চ্যালেঞ্জ।

অনেকে বলে- যেহেতু সবাই খবর ছড়াতে পারে, সাংবাদিকতার গুরুত্ব নাকি কমে গেছে। আমি উল্টোটা মনে করি। যখন ভুয়া খবর সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায়, তখন প্রকৃত সাংবাদিকতার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।

একজন সাংবাদিক শুধু খবর দেন না, মানুষের আস্থা গড়ে তোলেন। তার বিশ্বাসযোগ্যতাই হলো তার আসল শক্তি। আর সেই আস্থা ধরে রাখতে হলে তাকে আরও সতর্ক, আরও দক্ষ, আরও দায়িত্বশীল হতে হয়।

আমি নিজেও মাঝে মাঝে ভাবি, এখন যদি নতুন করে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়তে যেতাম, তাহলে কী করতাম? শুধু সাংবাদিকতার ক্লাসই যথেষ্ট হতো না। ডেটা বুঝতে হতো, ডিজিটাল টুলস আয়ত্ত করতে হতো, ভুয়া তথ্য ঠেকানোর দক্ষতা গড়তে হতো। আজকের ছাত্রছাত্রীরা সাংবাদিক হতে চাইলে শুধু লেখালেখি জানলেই চলবে না। তাদের জানতে হবে ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার, ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম, আর সবচেয়ে বড় কথা ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের কৌশল।

সাংবাদিকতা সহজ হয়নি। সংবাদ ছড়ানো হয়তো সহজ হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকতা, যেটা আসলে সত্য খোঁজা, দায়িত্ব নেওয়া, মানুষের আস্থা ধরে রাখা তা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে গেছে। আজ সাংবাদিকতা এক যুদ্ধের মতো, তথ্যের যুদ্ধ। আগে তথ্য পাওয়া কঠিন ছিল, এখন তথ্য অবারিত। সেখানেই সত্য আর মিথ্যার সংঘাত। আর এই যুদ্ধে সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। মাহাদী হাসান : জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়