শেখ হাসিনার আমল নিয়ে অন্যতম প্রধান অভিযোগ, সরকার ভিন্নমত সহ্য করত না; বরং বিরোধী দল ও মতকে বহুবিধ দমনপীড়নে স্তব্ধ করা হতো। জনপ্রত্যাশা ছিল, গণঅভ্যুত্থানজয়ী অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন করতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১৩ মাসে এই প্রত্যাশার বিপরীত চিত্রের দেখা মেলে; কার্যত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী মত আওয়ামী লীগকে দমনের পুনরাবৃত্তি দেখি। সম্প্রতি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দমনমূলক সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মাধ্যমে সরকারের সমালোচক ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, টানা তিন সপ্তাহ ধরে চলা শেখ হাসিনাবিরোধী বিক্ষোভে নিহত হয় প্রায় এক হাজার ৪০০ জন। সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে ২০২৫ সালের ১২ মে সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। দলটির সমর্থনে সভা, প্রকাশনা ও অনলাইনে দেওয়া বক্তব্য এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। আওয়ামী লীগের সদস্য ও অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারে আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশের মানুষকে যেসব সহ্য করতে হয়েছে, সেই একই ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ অন্তর্বর্তী সরকারের করা উচিত নয়। তা সেটা বিরোধী রাজনীতিবিদদের ধরে নিয়ে কারাগারে পুরে দেওয়া হোক বা শান্তিপূর্ণ ভিন্নমতকে বন্ধ করে দেওয়া, যেটাই হোক না কেন’ (সমকাল, ১০ অক্টোবর, ২৫)।
সংস্থাটির অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বহু মানুষকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন, যার মধ্যে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করার মতো বিষয়ও আছে।
স্বৈরাচারী সরকার শাসন নির্বিঘ্ন করতে কালো আইনের আশ্রয় নিয়েছিল; অন্তর্বর্তী সরকারকে কেন সেই আইনের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে? এখনও কেন সেই ভিন্নমত দমন, জেলে পোরা, হাতকড়া হাতে মৃত্যু? ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছিল। ১৬ বছর ধরে আইনটির বিরোধিতা করে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তারা কেন সেই আইনেই বিরোধী মত দমন করছেন! ক্ষমতায় যখন আমার অপছন্দের সরকার তখনকার ‘কালো’ আইন আমি ও আমরা ক্ষমতায় থাকলে ‘সাদা’ হয়ে যায়!
২. মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী। তাদের ওপর পুলিশের নিপীড়নের যে চিত্র দেখলাম সংবাদমাধ্যমে, তাতে মানুষ হিসেবে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। কত টাকা বৃদ্ধির আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষকরা? এখন তারা পান এক হাজার টাকা, আরও দুই হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন। এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া? দুই হাজার টাকা বৃদ্ধির দাবি? শিক্ষকদের এই দাবির বিপরীতে পুলিশ তাদের পিটিয়ে, টেনেহিঁচড়ে, জামা ছিঁড়ে ট্রাকে তুলছে; দেশ গড়বার কারিগর, অপমানিত সেই শিক্ষকদের কাছে আবারও পাঠ নেবে আমাদের শিশুরা! এরপরও আমরা চাইব একটি উন্নত-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র?
রাষ্ট্রের ক্ষমতাবিন্দুতে যারা থাকেন, তাদের কাছে এক হাজার বা দুই হাজার টাকা নিশ্চয়ই হাস্যকর অঙ্ক। কী হয় এতে? তাদের এক সন্ধ্যার কফি বিলও সম্ভবত নয়। কিন্তু শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া দিতে হয় এই টাকায়। কোথায় এই টাকায় শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া মেলে, কেউ কোনোদিন তার সন্ধান নিয়ে দেখেন না। দেখেন না বলেই শিক্ষা ও শিক্ষকতা আজ উপহাসের বিষয়। গত এক বছরে রাষ্ট্রের নানা প্রান্তে মব সন্ত্রাস দেখতে দেখতে ক্লান্ত জাতি; পুলিশ নির্বিকার ও নিষ্ক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, বিভিন্ন মাজার কিংবা ধানমন্ডি ৩২ ভাঙার সময়ও কোথাও পুলিশের তৎপরতা দেখা যায় না। শিক্ষকদের ওপর তাদের খড়্গহস্ত হতে দেখে বলতেই হয়, পুলিশ সুবিধা ও ইচ্ছেমতো সক্রিয় হয় বটে!
৩. অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল, তারা কিছু নজির স্থাপন করবে, যা পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার জনকল্যাণের গুরুত্বে অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। যেহেতু রাজনৈতিক এজেন্ডা তাদের নেই, কাজেই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থচিন্তা তারা করবে না। দৃষ্টিগ্রাহ্য আইনশৃঙ্খলার সূচনা তারা করে যাবে। বাস্তব বিশ্লেষণ করলে বিপরীত সত্য দেখতে পাই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত ভঙ্গুর বললেও কম বলা হয়। বিশেষত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী হাল, যারা সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে সরকারি হাসপাতালে গিয়েছেন, তারাই জানবেন। ঊর্ধ্বতন পরিচিত না থাকলে ঠিকানা হাসপাতালের বারান্দাই; ডাক্তারের দেখা মেলা ভার। উপজেলা বা প্রান্তিক অঞ্চলের হাসপাতাল নিয়ে কথা বলাই মুশকিল; এগুলো হাসপাতাল, না সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র– তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। শিক্ষা খাতেও মুমূর্ষু অবস্থা; কিছুতেই সরকার এদিকে দৃকপাত করে না।
সত্য, স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা আনতে বাজেট জরুরি; সময়সীমাও একটি বিষয় বটে। তবে যে কোনো জায়গা থেকে শুরু করা যেত। ১৩ মাসে কোথাও শুরুর দেখা মিলল না। আর আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতের মতো বড় বাজেট প্রয়োজন হতো না; প্রয়োজন ছিল দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা। কিন্তু সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই যেন সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
চব্বিশের আসামান্য গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার এমন কিছু কাজ করছে, যাতে অনিবার্যভাবেই মনে হতে পারে যে, দেশে ভিন্নমতের জায়গা নেই। আওয়ামী লীগের সব কর্মী নিশ্চয়ই চব্বিশের আন্দোলনে খুনি হিসেবে আবির্ভূত হননি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় যুক্ত আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও সবাই অবশ্যই অপরাধী নন। কিন্তু ‘আওয়ামী দোসর’ ট্যাগ দিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষকে বিচ্ছিন্ন, হয়রানি, এমনকি অত্যাচার করা হচ্ছে। সমাজে এই বিচ্ছিন্নকরণ ও ভিন্নমতের দমনকে সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ আমলে যেমন ভিন্নমত মাত্রই জামায়াত-বিএনপি ট্যাগ দিয়ে অত্যাচার-অনাচার করা হয়েছে, এখন একইভাবে সরকারের সমালোচকদের ‘আওয়ামী দোসর’ ট্যাগ দিয়ে দমনপীড়ন চলছে।
এত প্রাণত্যাগ, আত্মত্যাগ– সবকিছুর মূলে আইনের শাসন ও জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা। দেশে সকল মত ও পক্ষের মানুষ পারস্পরিক সহাবস্থান ও সম্প্রীতির মধ্যে অবস্থান করবে। যিনি চোর বা ডাকাত, তারও মানবাধিকার থাকবে; ধারণা থেকে কাউকে সমাজচ্যুত করবার অধিকার অন্য কারও নেই। অপরাধীর জন্য যথাযথ আইন রয়েছে, তাকে বা তাদেরকে সেই আইনে বিচারের আওতায় আনবার দায়িত্বও সরকারের।
আইনের শাসন অনুশীলনের বদলে উগ্র ডানপন্থাসহ সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি সরকারের অনুরাগ সুস্পষ্ট। বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির প্রতি সরকারের বিরাগও অস্পষ্ট নেই। এসবই দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে মানুষ নিজ নিজ রাজনৈতিক অধিকার সমানভাবে চর্চা করতে পারেন। অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় উত্তীর্ণ হবে। এর ফল আমরা দেখব অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সুসম্পন্ন হবার মধ্য দিয়ে; গণতান্ত্রিক এই যাত্রাপথই জাতির রক্ষাকবচ। মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে