বিশ্বব্যাপী যখন বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ একটি ব্যতিক্রমী ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। বছরে গড়ে ২ হাজার ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, ৭০০ শতাধিক নদীনালা, অসংখ্য খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও জলাভূমি—এসব মিলিয়ে বাংলাদেশ একটি অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনার জলভান্ডার।
যেখানে বিশ্বে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ মিঠাপানি সরাসরি মানব ব্যবহারের উপযোগী, সেখানে বাংলাদেশের তুলনামূলক প্রাকৃতিক সুবিধা এক নতুন কৌশলগত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানির সংকট এখন একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম মারাত্মক হুমকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সরবরাহ থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে জাতিসংঘ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পানির চরম সংকটে পড়বে। বাংলাদেশের এই বিপুল জলসম্পদকে যদি প্রযুক্তি, নীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ রূপ নিতে পারে একটি বিশ্ব জল রপ্তানিকেন্দ্রে, যা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও পানিশূন্য এশীয় অঞ্চলগুলোতে উন্নত মানের বিশুদ্ধ পানির সরবরাহকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশের পানি বিশুদ্ধতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো দেশের পানির চেয়ে এগিয়ে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেট অঞ্চলের পানিতে পিএইচ ও টিডিএসের মাত্রা স্বাভাবিকভাবে বোতলজাতকরণের উপযোগী। টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার পানি ইতিমধ্যে উচ্চ বিশুদ্ধতার জন্য চিহ্নিত। এই অঞ্চলের পানির পিএইচ লেভেল ৬.৫, ৮.০ ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত: ৬.৫, ৮.৫। যা রীতিমতো অবাক হওয়ার মতো। এটাকে বাংলাদেশের জন্য একটা সোনার খনি বলা চলে। এ জন্যই বাংলাদেশের পানিকে ব্লু গোল্ড বলা যায়।
বর্ষা, নদী ও সম্ভাবনা : বাংলাদেশের বর্ষা শুধুই মৌসুমি ঘটনা নয়; এটি একটি অর্থনৈতিক সুযোগ। জুন-সেপ্টেম্বর মাসে দেশের মোট বৃষ্টিপাতের ৮০ শতাংশের বেশি ঘটে। এই পানির একটি অংশ যদি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষণ ও পরিশোধন করা যায়, তবে তা রপ্তানিযোগ্য বিশুদ্ধ পানিতে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশের নদ-নদীর মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ২০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, যা বিশ্বের অনেক বড় নদীব্যবস্থার চেয়ে বেশি। এসব পানির বিশাল অংশ সামান্য পরিশোধনেই ডব্লিউএইচও এবং আইএসও মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী বোতলজাত পানির বাজার বর্তমানে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজারের পরিধি ৫২৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই বাজারের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার (সিএজিআর) প্রায় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা এ খাতকে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও রপ্তানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বিশ্বের বোতলজাত পানির সবচেয়ে বড় ভোক্তা অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশসমূহ, যেমন সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। যেখানে বিশুদ্ধ, হালাল ও মিনারেলসমৃদ্ধ পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
এ ছাড়া চীন ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিশুদ্ধ বোতলজাত পানির বাজার উল্লেখযোগ্য হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব অঞ্চলে এক লিটার প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের পানির দাম বর্তমানে এক থেকে পাঁচ ডলার পর্যন্ত, বিশেষ করে যেসব পানি হিমবাহ থেকে সংগৃহীত, স্নো ফিল্টারড বা হালাল সার্টিফায়েড।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। দেশের প্রচুর প্রাকৃতিক মিঠাপানির উৎস, খরচ-সাশ্রয়ী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং দক্ষ জনশক্তি ব্যবহার করে যদি বাংলাদেশ এই বিশাল বাজারের মাত্র ১ শতাংশও অর্জন করতে সক্ষম হয়, তবে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত রপ্তানি আয় সম্ভব হতে পারে। শুধু তা–ই নয়, এই খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং বহুজাতিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের দ্বারও উন্মুক্ত হবে।
বাংলাদেশের উচিত এখনই একটি সুসংগঠিত পানির শিল্পভিত্তিক রপ্তানি কৌশল গ্রহণ করা। আধুনিক বোতলজাত পানি উৎপাদনের জন্য আলাদা শিল্পাঞ্চল নির্ধারণ, হালাল ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্র্যান্ড তৈরির উদ্যোগ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রবেশ এবং ‘ওয়াটার এক্সপোর্ট পলিসি’ প্রণয়নের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
বিশ্বের জলবায়ু সংকট ও বিশুদ্ধ পানির ঘাটতির প্রেক্ষাপটে বোতলজাত পানির বাজার যে আগামী দিনের একটি অর্থনৈতিক খনি, তা এখন আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত পরিকল্পনা যদি একত্রে কাজে লাগানো যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বিশ্বের ‘ওয়াটার ইকোনমি’র অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা সম্ভব। পরিকাঠামো ও প্রযুক্তিভিত্তিক রূপান্তর পরিকল্পনা বাংলাদেশের জলসম্পদকে একটি বাণিজ্যিক শক্তিতে পরিণত করতে নিচের পাঁচটি ধাপে রূপকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে:
১. বর্ষার পানি সংরক্ষণের জন্য পরিবেশবান্ধব জলাধার ও বাঁধ নির্মাণ। হাওর-বাঁওড়সংলগ্ন আধুনিক ড্রেনেজ ও ওভারফ্লো খাল গঠন।
২. আন্তর্জাতিক মানের পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন। আরওইউভি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিশোধন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে শোধনাগার স্থাপন। হাওর অঞ্চলকে ‘জল শিল্পাঞ্চলে’ রূপান্তর।
৩. বোতলজাত পানি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল, শুল্কছাড়, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধাসহ রপ্তানিকেন্দ্রিক শিল্প এলাকা গঠন।
৪. ডব্লিউটিও অনুমোদিত সার্টিফিকেশন ও ট্রেসেবিলিটি ব্যবস্থা। জাতীয় পানি মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠন। প্রতিটি রপ্তানি ইউনিটে গুণমানের ডিজিটাল ট্রেসিং ব্যবস্থা।
৫. ব্র্যান্ডিং: বাংলাদেশ পিওর ওয়াটার, সরকার-সমর্থিত ব্র্যান্ড, যার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও হালাল পানির গ্লোবাল বাজারে প্রবেশে নিশ্চয়তা।
বিশ্বব্যাপী পানি অর্থনীতির বিকাশে বিভিন্ন দেশ নিজেদের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, প্রযুক্তি ও বাজার কৌশলের ওপর ভিত্তি করে অনন্য পানিনির্ভর মডেল গড়ে তুলেছে। সিঙ্গাপুর একটি স্বল্প পানিসম্পদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিউওয়াটার প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনর্ব্যবহৃত পানি ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব এনেছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা বর্জ্য জলকে পরিশোধন করে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা পুনর্ব্যবহারযোগ্য, এমনকি রপ্তানিযোগ্য হয়ে ওঠে। এটি শুধু সিঙ্গাপুরকে পানির দিক থেকে স্বনির্ভরই করেনি, বরং টেকসই নগর উন্নয়নের একটি রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলেছে।
অন্যদিকে সৌদি আরব মরুপ্রধান একটি দেশ হিসেবে পরিশোধন প্রযুক্তি ও হালাল পানির মানদণ্ড অনুসরণ করে এক বিশেষায়িত পানির বাজার তৈরি করেছে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি পরিশোধন করে তারা ভোক্তা ও ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল বাজারকে লক্ষ্য করে ‘হালাল পানি’ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করছে, যা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।চীন পানির খনিজীকরণ ও বিশ্বায়ন কৌশল গ্রহণ করে পানি রপ্তানিকে একটি শক্তিশালী রপ্তানি খাতে রূপান্তর করছে। বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ পানি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। চীন এ প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের পানিকে ‘ফাংশনাল ওয়াটার’ হিসেবে রপ্তানির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।ফ্রান্স তাদের প্রাকৃতিক অ্যালপাইন ঝরনাধারা থেকে আহরিত ইভিআইএএন ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ন্যাচারাল স্প্রিং ওয়াটারের গুণগত মান ও বিলাসবহুলতা তুলে ধরেছে। এটি কেবল একটি পানির ব্র্যান্ড নয়, বরং একটি ‘লাইফস্টাইল’ প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত ও প্রিমিয়াম গ্রাহকদের মধ্যে জনপ্রিয়।
অন্যদিকে ভারত নিজস্ব ব্র্যান্ড, যেমন হিমালয়ান ও বিসলেরির মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ কৌশল নিয়েছে। দেশীয় বাজারে প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি তারা দক্ষিণ এশিয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য নিম্নমূল্যের সঙ্গে উচ্চমান বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে। ভারত পানিশিল্পকে একটি বর্ধনশীল ভোক্তা বাজার হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, একটি দেশ ভূপ্রকৃতি বা পানিসম্পদ যা–ই থাকুক না কেন, সঠিক কৌশল ও প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি অর্থনীতিতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিতে পারে। বাংলাদেশ তার নিজস্ব প্রাকৃতিক সুবিধার মাধ্যমে এই মডেলগুলো টেকসই ও কম খরচে বাস্তবায়ন করতে পারে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক কাঠামো দেশটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত করেছে। এখন সারা পৃথিবীর মধ্যে এটি একটি ‘পারফেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ডেস্টিনেশন’ হিসেবে গড়ে উঠেছে।
একদিকে ভারত, চীন ও আসিয়ান দেশসমূহের বিশাল বাজারের অতি নিকটে অবস্থান, অন্যদিকে কার্যকর সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনা—এ দুটি বিষয় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি কৌশলগত হাবে রূপান্তরিত করছে। চট্টগ্রাম, মোংলা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক রপ্তানি ও আমদানির জন্য আধুনিক অবকাঠামো এবং দ্রুত সংযোগ নিশ্চিত করছে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হলো এর সাশ্রয়ী শ্রম ব্যয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে দেশের গড় শ্রমিক ব্যয় মাত্র ১০৫ মার্কিন ডলার, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয় এবং শ্রমনির্ভর শিল্প খাতে বাড়তি সুবিধা প্রদান করে। টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি এবং দূরদর্শী কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে সেই ‘জল অর্থনীতির বৈশ্বিক বিপ্লবে’, যেখান থেকে বয়ে যাবে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার ধারা। ‘ব্লু গোল্ড বা নীল সোনা’র দিকে যাত্রা শুরু হোক এখানেই। কবীর আহমেদ ভূঁইয়া চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া ফাউন্ডেশন; রাজনৈতিক ও উন্নয়ন কৌশলবিদ। দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে