শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে ব্যবহার করে যেসব অপরাধ ঘটানো হয়েছে, তার মধ্যে গুম, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত। নির্বাচিত হয়ে আসা একটি সরকার বিরোধী দল দমনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক দুনিয়ায় কমই রয়েছে। অতীতে ক্রসফায়ারসহ বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটলেও এখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে গুম-খুনে একযোগে ব্যবহারের এত ব্যাপক প্রবণতা ছিল, বলা যাবে না। এ কারণেও বিগত শাসনামলটি বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যেসব ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার অনুষ্ঠানে উদ্যোগী হয়েছে, তার মধ্যে স্বভাবতই রয়েছে গুম, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগ। এ লক্ষ্যে গঠিত কমিশনের তদন্তে উদ্ঘাটিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি একটি তথ্যচিত্র অনেকেই দেখছে। এর আগে গুম-সংক্রান্ত যেসব খবর বিচ্ছিন্নভাবে জানা যাচ্ছিল, সেগুলোও ছিল লোমহর্ষক। ‘আয়নাঘর’ নামের গোপন বন্দিশালা ও নির্যাতন কেন্দ্র উন্মোচিত হয় গণঅভ্যুত্থানের কিছুদিনের মধ্যেই। স্পর্শকাতর বলে বিবেচিত এলাকায়ও এগুলো গড়ে তোলার খবর জানা যায়। প্রধান উপদেষ্টা সেগুলো পরিদর্শনে যতদিনে যান, ততদিনে সেগুলোর কাঠামো পরিবর্তন ও নির্যাতনে ব্যবহৃত সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলার খবর মেলে।
গুম, খুন ও নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এমন অপরাধ নিয়ে বিগত সরকারের আমলেই কথা ওঠে। গুমের শিকার পরিবারগুলোও যথাসম্ভব সোচ্চার হয়। কিন্তু প্রবল ক্ষমতাবান সরকারের আমলে বিচার বিভাগেও এর প্রতিকার মেলেনি। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের এলিট ফোর্সটির ওপর অবশ্য জারি হয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। তাদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের পাশাপাশি গুমের অভিযোগ তুলছিল নামকরা মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ইইউ পার্লামেন্টেও বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কম উদ্বেগ জানানো হয়নি। এর চাপে ক্রসফায়ার কিছুটা কমে এলেও গুম, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যেতে দেখা যায়।
প্রতিটি একতরফা নির্বাচনের আগ দিয়ে কিংবা সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধলেই গুমের ঘটনা বেড়ে যেত বলে গুম কমিশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। ২০১৫ সালে তখনকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে দৃশ্যত অপহরণ করা হয়। বেশ কিছুদিন পর তাঁকে পাওয়া যায় ভারতের মেঘালয়ে। সেখানে চিকিৎসা ও দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তিনি দেশে ফেরেন। অনুসন্ধানে এমন আরও কয়েকটি ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। একটি যুদ্ধাপরাধ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামির অপহরণের শিকার হয়ে ভারতীয় কারাগার থেকে দেশে ফেরার কাহিনি তো বহুল আলোচিত।
গুম কমিশনের তথ্যানুসন্ধানে যা বেরিয়ে আসছে, তাতে ভারতের দিকেও আঙুল উঠছে। এ ধরনের অভিযোগের নিষ্পত্তি কীভাবে হবে, কে জানে! এদিকে দেশে গুমের অভিযোগে ইতোমধ্যে দায়ের মামলায় যাদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ২৫ জনই সেনা কর্মকর্তা। এদের একাংশ সাবেক আর পলাতক হলেও অপরাংশ কর্মরত ছিলেন। পরোয়ানা জারির খবর পেয়ে সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব হেফাজতে নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনী মোতাবেক তারা এখন আর স্বপদে বহাল নেই। তবে তারা সেনা হেফাজতেই থাকবেন কিনা– এ নিয়ে এক প্রকার জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সেনা কর্মকর্তা হলেও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিচার সেনা আইনে হচ্ছে না– এটাই সরকারের অবস্থান।
অপরাধী যে-ই হোক, তার বিচার হতে হবে। অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত অবশ্য সবাই নিরপরাধ। তাদের প্রতি সদাচরণ রাষ্ট্রের কর্তব্য। আইন কিংবা এর ব্যাখ্যায় অস্পষ্টতা থাকলে তা দূরীকরণের সুযোগও রয়েছে। কিন্তু গুরুতর অভিযোগ থেকে কেউ রেহাই পেতে পারে না। গণতান্ত্রিকভাবে আসা একটি সরকারের আমলে বিচার ব্যবস্থা এড়িয়ে গুম, নির্যাতন ও খুনের ধারাবাহিক ঘটনাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বাছাইকৃত সদস্যদের এমনতর কাজে ব্যবহারও ভয়ানক অপরাধ। উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায়ে যারাই এতে জড়িত থাকুক, তাদের দায় সঠিকভাবে নির্ণীত হতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিকল্পনাতেই ওইসব ঘটার অভিযোগ উঠছে; যদিও দায়িত্বে থাকাকালে এসব অভিযোগ তারা বেমালুম অস্বীকার করতেন।
গুম-সংক্রান্ত মামলায় অপর যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাদের আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। গণঅভ্যুত্থানে ভেঙে পড়া পুলিশ অবশ্য এখনও যথেষ্ট সক্রিয় হতে পারেনি। তাদের নিয়মিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছেন সেনাসদস্যরা। এদিকে জাতীয় নির্বাচন বেশি দূরে নয়। সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী নির্বাচনে তাদের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় জোরাল ভূমিকা নিতে হবে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনপ্রত্যাশী জনগণও সেটা চায়। এ অবস্থায় গুমের ঘটনায় দায়ের মামলা ঘিরে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সেনা কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের অবনতি কাম্য নয়। উস্কানি দেওয়ার মতো মহল অবশ্য কম নেই। এ অবস্থায় গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো কারণে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির কাজ যেন ব্যাহত না হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে বড় অগ্রগতির সময় থাকবে না বলেই ধরে নিতে হবে। এ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে নির্বাচিত সরকারকে। সে কারণেই আসছে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে এ ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী প্রত্যেক মানুষ যেন এ বিষয়ে আশ্বস্ত থাকতে পারে। বাংলাদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র চেয়ে আসা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দেখতে চাইবে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সরকারের দৃঢ় ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে তারা শুরু থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশেও রয়েছে। খোদ জাতিসংঘ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনে বিগত সরকারের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি সামনে এনেছে নিজে থেকে তথ্যানুসন্ধান করে। গুম, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তিতেও তাদের সহায়তা থাকবে নিশ্চয়।
সুষ্ঠু নির্বাচন, ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের পথ পরিত্যাগ করে আওয়ামী লীগ সরকার যে পথ অবলম্বন করেছিল, তাতে নজিরবিহীন নানা অপরাধে জড়াতে হয়েছে তাদের। হীন লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে বিচার বিভাগের যেটুকু স্বাধীনতা ছিল, তারও অবনমন ঘটায় সরকার। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ন্যূনতম কার্যকারিতাও বিনষ্ট করে দেয়। এ প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশকেও ব্যবহার করে সরকার। গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে সফলতম বেসরকারি ব্যাংক দখলের ঘটনাও বিশ্বে সম্ভবত নজিরবিহীন। এভাবে ব্যাংক খাতের একাংশকে কবজা ও লুট করে আমানতকারীদের পথে বসানো হয়। লুণ্ঠিত অর্থ পাচারের খবরগুলোও কম বিস্ময় জাগাচ্ছে না। গুম-খুনের পাশাপাশি আর্থিক খাতকে হত্যারও আয়োজন চলছিল। এরও কি বিচার হতে হবে না? হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে