২৬শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আর্ন্তজাতিক
ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান

চীনের তিব্বত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প : আচরণগত অর্থনীতির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ

চীনের তিব্বত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প : আচরণগত অর্থনীতির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ

‘তিব্বতের ইয়ারলুং জাংপো নদীর ওপর নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে চীন। এ প্রকল্প ভাটির দেশ ভারত এবং বাংলাদেশে পানির নিরাপত্তা নিয়ে পুরোনো উদ্বেগকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে।’

তিব্বতে চীনের নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ এবং ভারত ও বাংলাদেশের পানির নিরাপত্তা ও উদ্বেগের বিষয়টিকে আচরণগত অর্থনীতি ব্যাখ্যা করে যেÑ মানুষ লাভের চেয়ে ক্ষতি এড়াতে বেশি আগ্রহী। এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এ বাঁধ নির্মাণ সম্ভাব্য পানির ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়া মানে কৃষি, অর্থনীতি এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব। সম্ভাব্য এ ক্ষতি এতটাই তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে যে, এটি দেশগুলোর মধ্যে প্রবল উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তাদের কাছে এটি কেবল একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়, বরং তাদের জীবন-জীবিকা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সরাসরি আঘাত।

মানুষ সাম্প্রতিক বা সহজে মনে রাখা যায় এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর চীনের আগেও বাঁধ নির্মাণ বা পানিসম্পদ নিয়ে পুরোনো বিতর্কগুলোর কথা ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের মনে আছে। এ পুরনো উদ্বেগগুলো সহজেই মনে আসে এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করিয়ে দেয়। যখনই নতুন করে কোনো বাঁধের খবর আসে তখনই অতীতের দুশ্চিন্তাগুলো নতুন করে ফিরে আসে; যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।

চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘোষণা এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগের ক্ষেত্রে তথ্যের অসম্পূর্ণতা একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। চীন প্রকল্পটির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। প্রকল্পটি কিভাবে নির্মিত হবে, পানি প্রবাহের ওপর এর প্রভাব কী হবে, বা পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ কতটা হবে, তা আমাদের অজানা। এ তথ্যের অভাব ভারত ও বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তারা সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কা করছে, যা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করছে। এ ক্ষেত্রে, ভারত ও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ ধরে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কারণ তথ্যের অভাব তাদেরকে ঝুঁকি এড়ানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটি আচরণগত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে অসম্পূর্ণ তথ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তা বাড়ায়।

চীন এটিকে তার দেশের উন্নয়নের জন্য একটি অপরিহার্য প্রকল্প হিসেবে দেখছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। তাদের কাছে এটি একটি ‘উন্নয়নমূলক অর্জন’ হিসেবে ফ্রেম করা হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দেশদুটো এটিকে ‘পানির উৎস সীমিতকরণ’ বা ‘পরিবেশগত হুমকি’ হিসেবে ফ্রেম করছে। এ নেতিবাচক ফ্রেমের কারণে উদ্বেগ আরও বাড়ছে এবং সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পারস্পরিক আস্থা ও ন্যায্যতার অনুভূতি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের একতরফা সিদ্ধান্ত আন্ত:সীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনায় কোন সমন্বয় ছাড়াই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘অন্যায্য আচরণ’-এর অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে, যা আচরণগত অর্থনীতিতে বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে পরিচিত।

চীন বনাম ভারত-বাংলাদেশ উভয়পক্ষ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সর্বোৎকৃষ্ট ফল পেতে পারে; কিন্তু আস্থার অভাবে প্রত্যেকে স্বার্থপর সিদ্ধান্ত নেয়। চীন নিজের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করে, অন্যদিকে ভাটির দেশগুলি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।

আচরণগত অর্থনীতিতে গ্রুপ আচরণ বা সামাজিক পরিচয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশগুলো তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং পরিচয়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়।

চীন এ প্রকল্পকে তাদের জাতীয় স্বার্থের অংশ হিসেবে দেখছে, যেমনÑ কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন, তিব্বতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন। অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতে এ প্রকল্পকে হুমকি হিসেবে দেখছে, কারণ এটি তাদের কৃষি, পানি সরবরাহ এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে- অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে বিদ্যমান উত্তেজনাও এ উদ্বেগকে আরও জটিল করছে।

এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং গ্রুপ পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। চীনের জন্য এটি একটি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য, কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত। এ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আঞ্চলিক সহযোগিতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

প্রত্যেক দেশই নিজেদের অবস্থান এবং নিজেদের কৌশল সম্পর্কে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হতে পারে। চীন মনে করতে পারে যে তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্বের অধিকারের কারণে তারা সহজেই এ প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে পারবে। অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশ মনে করতে পারে যে তাদের কূটনৈতিক চাপ বা আন্তর্জাতিক সমর্থন দিয়ে এ প্রকল্পকে প্রতিহত করা সম্ভব। এ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সম্ভাব্য সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। লেখক : ডেপুটি চিফ (প্ল্যানিং), ঢাকা ওয়াসা