জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বাংলাদেশ এক নজিরবিহীন স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে বলে জানিয়েছে ‘দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ। সংস্থার সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, শুধু ২০২৪ সালেই তাপজনিত শ্রম উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় সম্ভাব্য ২৪ বিলিয়ন ডলার আয় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০২২ সালে মানবসৃষ্ট বায়ু দূষণের কারণে ২ লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গরমসংক্রান্ত অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
২০২৪ সালে গড়ে প্রত্যেক ব্যক্তি ২৮.৮ দিন করে তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩.২ দিন কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে, ১৯৫১-১৯৬০ সময়ের তুলনায় ২০১৫-২০২৪ সময়কালে ডেঙ্গু সংক্রমণের উপযোগী আবহাওয়া বেড়েছে ৯০ শতাংশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যৌথভাবে এর আয়োজন করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিইআর) এবং দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন গ্লোবাল টিম। এতে সহযোগিতা দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিট।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও গ্রিনথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো, ড. সৌর দাশগুপ্ত। বার্ষিক এই আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনটি বিশ্বের ৫০টিরও বেশি সূচক বিশ্লেষণ করে, যেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ু দূষণ, খরা, রোগের প্রাদুর্ভাব এবং কৃষি ও শ্রমক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতির তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, যতদিন যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব পড়ছে। গত এক হাজার বছর ধরে যা হয়নি তা আগামী ৩০ বছরে ঘটবে। আমরা ইতোমধ্যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছি। আমরা এখন ১৪টি জলবায়ুজনিত ঝুঁকি চিহ্নিত করেছি, যার মধ্যে তাপজনিত চাপ ও পানি নিরাপত্তাহীনতা সরাসরি মানবস্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয়দের কাছ থেকে আমি শুনেছি লবণাক্ততা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার কথা। পান করার মতো পানি নেই। পরিবারগুলো ৩,০০০-৪,০০০ লিটার ধারণক্ষম ট্যাংক কিনছে ছাদের বৃষ্টির পানি জমা করার জন্য, আর এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব ভয়াবহ। ল্যানসেট কাউন্টডাউন প্রতিবেদন জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর স্বাস্থ্যগত পরিণতি তুলে ধরেছে। এখন আমাদের গুরত্ব দিয়ে এ খাতে কাজ করতে হবে।
প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯০-এর দশক থেকে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব দ্রুত বেড়েছে বাংলাদেশে। তাপজনিত কারণে ২০২৪ সালে ২৪ বিলিয়ন সম্ভাব্য কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছে, যা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেশি। এই ক্ষতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কৃষি খাতে। মোট ক্ষতি হওয়া সময়ের ৬৪ শতাংশই এ খাতের শ্রমিকদের। এর ফলে, বাংলাদেশের সম্ভব্য মোট আয় কমেছে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ এবং কৃষি খাতের আয়ের ৫৫ শতাংশের সমান
প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এখনো অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ। ২০২২ সালে সূক্ষ্ম বস্তুকণার (পিএম ২.৫) সংস্পর্শে এসে ২ লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। এদের মধ্যে ৯০ হাজার মৃত্যুর সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো সরাসরি দায়ী, যার মধ্যে ৩০ হাজার মৃত্যু ঘটেছে কয়লা পোড়ানোর কারণে। ঘরোয়া বায়ু দূষণে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৭৪ জন মারা যায়- যা নারী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।
২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার এখনো মাত্র ০.৮৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির পেছনে যা কার্বন ট্যাক্স বা নিঃসরণ হ্রাস থেকে অর্জিত যে কোনো লাভের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, আমরা সাভারকে একটি নিয়ন্ত্রিত বায়ুমান অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছি এবং সেখানে কোনো ইট পোড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। গৃহস্থালি বায়ুদূষণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে আমরা অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতায় যৌথভাবে বৈদ্যুতিক চুলা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি, যা বায়ুমানের উন্নতি ঘটাবে। তাপজনিত চাপ মোকাবিলায় আমরা সিটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। এছাড়া, আমাদের এনডিসি লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করা। আমরা কপ-৩০ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিষয়ক আলোচনা জোরদার করতে চাই।