১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশ

শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার মুছে দিতে চায় বাংলাদেশ : দ্য ডিপ্লোম্যাটের মূল্যায়ন

শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার মুছে দিতে চায় বাংলাদেশ : দ্য ডিপ্লোম্যাটের মূল্যায়ন

অমিত রঞ্জন ও ধীময়ী ব্যানার্জি: একটি জাতি গঠন দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। যার জন্য অন্যান্য অনেক উপাদানের পাশাপাশি এমন একজন বীরের প্রয়োজন হয় যাকে দেশের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ গ্রহণ করে। ঔপনিবেশিক-পরবর্তী দেশগুলোতে এই ধরনের বীর মূলত সেই ব্যক্তিকে গণ্য করা হতো, যিনি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে দেশকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করেছিলেন। একজন দেশনায়ক, মানুষ হিসেবে নিখুঁত নাও হতে পারেন। আর তাই একটি গণতন্ত্রে, তার কিছু সিদ্ধান্ত পরবর্তী প্রজন্মের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ এবং সমালোচিত হয়। গণতন্ত্রের বিপরীতে একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় একজন শাসক প্রায়শই তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দেশের নায়কের ভাবমূর্তি ব্যবহার করে থাকেন। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার ভূমিকা নিয়ে কোনও গুরুতর বিতর্কের সুযোগ দেন না।

এমনই একজন বীর হলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধর অভিজাতদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেশের ইতিহাসে মুজিবের অবদানকে বিরোধীরা যতই নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করুক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এই বছর মুজিবের (১৯২০-১৯৭৫) ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিবকে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে হত্যা করা হয়। তার উপর অসন্তুষ্ট সেনা কর্মকর্তারা তাকে হত্যা করেন। ১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসনের অধীনে হোক বা সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন সরকার, মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য আখ্যানগুলোও জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই বছরগুলোতে ইসলামপন্থীরাও বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভিত্তি অর্জন করে।

বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের বীরোচিত ভূমিকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে মুজিবের নেতৃত্ব কতটা গণতান্ত্রিক ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য তার সরকার জাতীয় রক্ষী বাহিনী (ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স) গঠন করে, যা মূলত তার রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর নৃশংসতা চালায়। মুজিব সরকার দেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করে, একদলীয় শাসন এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পথ প্রশস্ত করে। ১৯৭৫ সালে সাংবিধানিক সংশোধনীর পর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অধীনে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বেশিরভাগ সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়।

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের (১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০২৪) মেয়াদে মুজিব দেশের মানুষের মননের কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেন। হাসিনা হলেন মুজিবের কন্যা। ১৯৭৫ সালের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া তার পরিবারের একমাত্র সদস্য ছিলেন তিনি এবং তার বোন রেহানা। ২০২৪ সালে যখন হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় তখন মুজিবের উত্তরাধিকারকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। বিক্ষোভকারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়ালচিত্র, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে থেমিসের মূর্তি, স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাস্কর্য, ময়মনসিংহে শিল্পাচার্য জয়নুল
আবেদিনের ভাস্কর্য, মেহেরপুরে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্য – ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষোভকারীরা ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামেও ভাঙচুর করে।

ছয় মাস পর ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপনকারী হাসিনা অনলাইনে ভাষণ দেন, যেখানে তিনি তার সমর্থকদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তখন একদল জনতা, যাদের অনেকেই ছাত্র বিক্ষোভকারীদের সাথে যুক্ত, মুজিবুর রহমানের বাসভবন ধানমন্ডি-৩২-এ আগুন ধরিয়ে দেয়। পাবনা, চুয়াডাঙ্গা এবং রংপুরেও বিক্ষোভকারীরা মুজিবুর রহমানের দেয়ালচিত্র নষ্ট করে এবং জেলা আওয়ামী লীগ অফিস লক্ষ্য করে হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সম্পর্কিত মূর্তি এবং প্রতিকৃতি লক্ষ্য করে। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সম্পর্কিত মূর্তি এবং প্রতিকৃতি নষ্ট করে দেয়।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের দ্বারা গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির(এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন যে, ‘ তাঁর (শেখ মুজিব) নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভারতের একটি উপনিবেশ রাজ্যে পরিণত হয়। তার সময়েই ১৯৭২ সালে জনবিরোধী সংবিধান আরোপিত হয় এবং লুটপাট, রাজনৈতিক হত্যা ও একদলীয় বাকশাল একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।’ প্রতিষ্ঠিত আখ্যানের বিরুদ্ধে যেকোনো চ্যালেঞ্জের শুরু হয় তরুণ শিক্ষার্থীদের চেতনা গঠনের মাধ্যমে। হাসিনার পরবর্তী সময়ে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ভিন্ন দৃশ্যকল্প তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা পূর্বে বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তকগুলো সংশোধন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। পাঠ্যপুস্তকগুলোতে পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়ায় জড়িত রাখাল রাহার ভাষায়, সংশোধনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাস থেকে তাদের মুক্ত করা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা শ্রেণি নবম ও দশম’ ( “History of Bangladesh and World Civilization Classes Nine and Ten) শীর্ষক ২০২৫ সালের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে, মুক্তিযুদ্ধে মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের ২০২ পৃষ্ঠায় মুজিবের ১৯৭১ সালের বিখ্যাত ‘মার্চের’ ভাষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই ভাষণে মুজিব বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির জন্য। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার জন্য’।

বইটির ২০৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে তিনি আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’ তবে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অসন্তোষের মুখেও বইটিতে মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।

উল্লেখযোগ্যভাবে, এই বছরের জুন মাসে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উল্লেখকারী ২০২২ সালের আইন পরিবর্তন করে। দেশ নায়ক এবং প্রতীকগুলো কেবল ইতিহাসের অংশ নয়। কিছু ক্ষেত্রে, ভবিষ্যতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার জন্যও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ইতিহাস তৈরি করা হয়। আর তাই প্রতীকগুলো একটি জাতির মনন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং প্রায়শই সহিংস ঐতিহাসিক ভাঙ্গনের কারণে পরিবর্তিত হয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুজিবের ভূমিকা মুছে ফেলা যাবে না। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভিন্নভাবে তা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। হাসিনা-পরবর্তী যুগে মুজিবের মূর্তির উপর আক্রমণ এবং তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন মূলত হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রতিফলন। যিনি তার স্বৈরাচারী শাসনকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বাবার ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করেছিলেন। এখন মুজিব বিরোধী শক্তিগুলোও ভুল ঐতিহাসিক তথ্য ব্যবহার করছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সূত্র : দ্য ডিপ্লোম্যাট – লেখক অমিত রঞ্জন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজেরএকজন রিসার্চ ফেলো। ধীময়ী ব্যানার্জি যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডক্টরেট ছাত্রী।