যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় নতুন এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশী-আমেরিকান মুসলিম নারী সোমা এস সাঈদ পবিত্র কোরআনে হাত রেখে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স সিভিল কোর্ট হাউসে আয়োজিত এক আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে তিনি শপথ নেন। অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা, ক‚টনৈতিক প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
শপথ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত রীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এসময় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী নাজিয়া জাহান। উদ্বোধন করেন ইমাম শামসি আলী। শপথ বাক্য পাঠ করান আপিল কোর্টের প্রধান বিচারক রোয়ান উইলসন। এসময় কোরআন ধরে রাখেন মিজানু চৌধুরী। রোবিং সেরিমনিতে অংশ নেন মিজানুর চৌধুরী, আয়ান চৌধুরী, আলিশা চৌধুরী, ডা. নাসরিন সৈয়দ, জাহিন সৈয়দ, আরিয়ান চৌধুরী ও অনিকা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি স্যালি ই. উঙ্গা। অনুষ্ঠানে বিচারপতি সোমা এস সাঈদ ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইউএস কংগ্রেসম্যান গ্রেগরি মিকস, নিউইয়র্ক সিটি কম্পট্রোলার মার্ক লেভিন, কুইন্স বরো প্রেসিডেন্ট ডনোভান রিচার্ডস জুনিয়র, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী, নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর টবি অ্যান স্ট্যাভিস্কি ও জন সি ল্যু, স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান ডেভিড আই ওয়েপ্রীন, সাউথ এশিয়ান ইন্দো-ক্যারিবিয়ান বান অ্যাসোসিয়েশন, কুইন্সের উপদেষ্টা বোর্ড সদস্য এটর্নী আলী নাজমী, জাস্টিস ইনিশিয়েটিভের এডউইনা জি রিচার্ডসন ও সিসিআই’র টেকনোলজি এডভাইজার মিজানুর চৌধুরী। সমাপনী বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে গেøাবাল পিস অ্যামবেসেডর ড. ইমান্যুয়েল অ্যাসে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার অ্যাটর্নি রোন্ডা বিন্ডা ও আয়েশা দেওয়ান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন শ্রেনী পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন।
এদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে পবিত্র কোরআনে হাত রেখে শপথ গ্রহণের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় বৈচিত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিচারব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। সোমা সাঈদের এই সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক আনন্দ ও উচ্ছ¡াস লক্ষ্য করা গেছে। অনেক স্থানে মিষ্টি বিতরণ ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে এ অর্জন উদযাপন করা হয়।

জানা যায়, গত ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের ভোটে সোমা সাঈদ বিচারপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রে স্টেট ও স্থানীয় পর্যায়ের বিচারক ও বিচারপতিরা সাধারণত দলীয় ও সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এর আগে ২০২১ সালে সোমা সাঈদ কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট জাজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনাঙ্গনে তার পেশাগত দক্ষতা ও কমিউনিটি সম্পৃক্ততার কারণে তিনি বাঙালী কমিউনিটিতে একজন পরিচিত মুখ হিসেবে পরিচিত।
নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিক্রিয়ায় সোমা সাঈদ বলেন, এ অর্জন কেবল তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সংখ্যালঘু ও অভিবাসী কমিউনিটির জন্যও অনুপ্রেরণার একটি বার্তা।
বিচারপতি সোমা সাঈদ নিউইয়র্ক সিটি ইক্যুয়াল রাইটস এনফোর্সমেন্ট কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং রাইট অব জাস্টিস কাউন্সিলের বোর্ড মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এশিয়ান আমেরিকান জাজ এসোসিয়েশনের সদস্য এবং কুইন্স কাউন্টি উইমেনস বার এসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। নিজের মেধা এবং কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে বিচারপতি সোমা একই সঙ্গে বাংলাদেশকেও অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আফতাবউদ্দিন সাঈদ এবং টাঙ্গাইলের গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আমিনা বেগম সাঈদের কন্যা সোমা ১২ বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকেই নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স বরোর জ্যামাইকায় বাস করছেন। নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুলে লেখাপড়ার পর সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি করেন সোমা সাঈদ।

এরপর ইউনিয়ন ইউনিভার্সিটির আলবেনি ল’ স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে জেডি করেছেন। টানা দেড় যুগের অধিক সময় অ্যাটর্নি হিসেবে পেশাগত জীবনযাপনের পাশাপাশি কমিউনিটির নানা কর্মকাÐে জড়িত থেকে সোমা নিজেকে বিশেষ এক অবস্থানে উন্নীত করতে সক্ষম হন। সেই সিঁড়ি বেয়েই ২০২১ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়নে কুইন্স কাউন্টিতে নিউইয়র্ক সিটি সিভিল কোর্টের বিচারক হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। এর পরের বছর তাঁকে ম্যানহাটনে অবস্থিত নিউইয়র্ক কাউন্টি ক্রিমিনাল কোর্টে বিচারপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং তিনি তা বিচক্ষণতার সঙ্গে ২০২৩ সাল নাগাদ পালন করেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারী থেকে পুনরায় কুইন্স কাউন্টি সিভিল কোর্টে বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়নে নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে বিজয়ী হন খবর ইউএনএ’র।