৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আর্ন্তজাতিক
ড. খালিদুর রহমান

গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ: মুক্তি নাকি ফ্যাসিবাদের নতুন পর্ব?

গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ: মুক্তি নাকি ফ্যাসিবাদের নতুন পর্ব?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিসর নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি অধ্যায়ই যেন সমাজকে নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমরা আসলে কোন পথে এগোচ্ছি? গণতন্ত্রের স্বপ্ন কতটা পূরণ হচ্ছে, আর কতটা ভেঙে যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব আচরণে? আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত যে বাস্তবতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হলো ভিন্নমত দমন, মব-রাজনীতি এবং আইন–শৃঙ্খলার স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারের বিষয়ে তীব্র উদ্বেগ।

দেশের অতীত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে স্পষ্ট হয়, বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশ চরম ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে ছিল। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, প্রশাসনিক কাঠামোর অবাধ ব্যবহার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কঠোর বিধিনিষেধ ছিল সেই সময়ের সাধারণ চিত্র।

শাহবাগ আন্দোলনসহ কিছু গণ-সমাবেশ, যা শুরুতে গণমঞ্চ হিসেবে দেখা দিলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। আইন–কানুন পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় নীতির পুনর্গঠন কিংবা বিশেষ রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে জনসমাগমকে কাজে লাগানো ছিল সেই সময়ের বৈশিষ্ট্য। বিরোধী মতকে দেশদ্রোহী বা অগ্রগতিবিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করা, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম–তোলার সংস্কৃতি ছিল ভয়াবহ বাস্তবতা। রাতের অন্ধকারে কাকে তুলে নিয়ে যাবে, তা কোনও নাগরিকই নিশ্চিত ছিলেন না।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটার পর নাগরিকদের প্রত্যাশা ছিল, এবার দেশে একটি গণতান্ত্রিক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে উঠবে। সবাই ধারণা করেছিলেন, অন্যায় ও দমনপীড়নের অন্ধকার সময় পেছনে ফেলে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের এক নতুন পথে এগিয়ে যাবে।

কিন্তু বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রে সে প্রত্যাশাকে হার মানাচ্ছে। ভিন্ন শক্তির হাতে ক্ষমতা গেলেও আচরণগত বাস্তবতায় মৌলিক কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। এখনও মব জড়ো করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া, অন্যের মত দমন করা এবং আইন ও নীতিমালার অপব্যাখ্যা একইভাবে ফিরে এসেছে নতুন রূপে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে, কোনও পোস্ট ভুল ব্যাখ্যা করা হলে কোন মব তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসতে পারে বা কবে কে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়বে। ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে ফেলা, প্রতিপক্ষের প্রতি চরম আক্রোশে মব জাস্টিসের ঘটনা নতুন শাসনের চরিত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সমালোচকদের মতে, এটি ফ্যাসিবাদেরই নতুন সংস্করণ; দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেন একটি দুষ্টচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। যখন এই স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে, তখন সমাজ ধীরে ধীরে চরম অস্থিরতার দিকে এগোতে থাকে। ইতিহাস প্রমাণ করে, যে রাষ্ট্রে আইনের বিচার নির্ভর নয় এবং মবের রায়ই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, সেখানে ন্যায়বিচারের মৃত্যু ঘটে।

আজকের বাংলাদেশে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তা হলো, মব-মানসিকতা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। মতভিন্নতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বা গোষ্ঠীবিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা, সামাজিক বয়কট, সমাবেশে ভীতি প্রদর্শন—এসব আচরণ শুধু গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর নয়, সমাজে সহিংসতার সংস্কৃতিও তৈরি করছে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে মব-জাস্টিস মানুষের মধ্যে অদ্ভুত এক ক্ষমতাবোধ তৈরি করে। একজন ব্যক্তি একা থাকলে যা করতে সাহস করেন না, লোকসমাগমে তা করতে দ্বিধা করেন না। এর ফলে যুক্তি, নীতি ও মানবিকতা উপেক্ষিত হয়, আর রাষ্ট্রের মূল আইনি কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

একটি স্থিতিশীল সমাজ কেবল আইন নয়; পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার ভিত্তিতেও গড়ে ওঠে। নাগরিকের অধিকার, বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা—এসব সমাজকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।

কিন্তু যখন মতভিন্নতার কারণে মানুষকে অপমান করা, হুমকি দেওয়া বা শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়া স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন সমাজ ভেঙে পড়তে শুরু করে। এমনকি কোনও অপরাধীর ক্ষেত্রেও মানবাধিকার বজায় রাখা জরুরি, কারণ বিচারবোধই একটি সভ্য রাষ্ট্রের মর্যাদা রক্ষা করে। শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপরাধীর মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত না থাকলে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়।

ব্যক্তি যখন অনুভব করেন যে তার মত প্রকাশের অধিকার নেই, তখন তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে যান। এতে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ কমে যায় এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশকে গভীর সংকটে ঠেলে দিতে পারে।

বাংলাদেশের সামনে আজ যে আরেকটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হলো, আমরা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার চেয়ে মতাদর্শিক বিজয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও জনকল্যাণ। কিন্তু যখন মতাদর্শিক লড়াই, দলীয় উত্তেজনা বা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার প্রতিযোগিতা সবকিছুর ওপর ছাপিয়ে যায়, তখন অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি একটি রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার প্রধান ভিত্তি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রপ্তানি বাজার, জ্বালানির মূল্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ—এসব রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও উন্নয়নের প্রধান উপাদান। কিন্তু আমরা যখন এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনায় সময় নষ্ট করি, তখন দেশ নিজেই নিজের ক্ষতি ডেকে আনে।

বাংলাদেশের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশে অস্থিতিশীলতা সবসময়ই নানা আন্তর্জাতিক শক্তির সুযোগ তৈরি করে। রাষ্ট্র দুর্বল হলে বহিরাগত শক্তি প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক পরাশক্তির কৌশলগত স্বার্থ এখানে জড়িত। দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে তারা নিজেদের মতো করে ডিপ স্টেট বা অভ্যন্তরীণ শক্তির মাধ্যমে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ পেতে পারে। এর ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অর্থাৎ, আমাদের ভুল সিদ্ধান্তই বাইরের শক্তিকে সুযোগ করে দেয় এবং ক্ষতিটা শেষ পর্যন্ত পুরো দেশের ওপর পড়ে।

বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেই যদি একই ধরনের দমন–পীড়ন, ভিন্নমত দমন বা মব-জাস্টিসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনোই সুস্থ হতে পারবে না।

সমাধান একটি—আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি, দল কিংবা মব নয়; আইনই হবে সর্বোচ্চ বিচারক। পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে হবে। ভিন্নমত থাকা অপরাধ নয়, বরং গণতন্ত্রের শক্তি।

রাষ্ট্র ও সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মানবিকতা লালন করতে হবে। রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈষম্য কমানোর কাজে।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সামনে আজ এক গভীর প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে। আমরা কি মুক্তি পেয়েছি, নাকি ফ্যাসিবাদের নতুন এক পর্বে প্রবেশ করছি? উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদের নিজেদের আচরণ, রাষ্ট্রের নীতি এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক চর্চাকে নতুনভাবে শক্তিশালী করতে হবে। অন্যায়ের পাল্টায় অন্যায় নয়; ন্যায়বিচারের আলোই পারে জাতিকে অন্ধকার থেকে বের করে আনতে। লেখক: অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।