১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কেন বাড়ছে সোনার মূল্য এবং এর পেছনের আসল কারণ

আমাদের সমাজে এমন খুব কম জিনিস আছে যেটার প্রতি মানুষের আগ্রহ যুগের পর যুগ ধরে একই রকম রয়ে গেছে, স্বর্ণ তার মধ্যে অন্যতম। বাড়িতে কোনো বিয়ে বা উৎসব মানেই স্বর্ণ কেনার ধুম। মা বা খালার স্বর্ণের গয়নার বাক্স যেন একেকটা ঐতিহাসিক স্মৃতির পাত্র। শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্বর্ণকে বরাবরই ধরা হয় নিরাপদ সম্পদ হিসেবে।

স্বর্ণের প্রতি এই ভালোবাসা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই সোনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হিন্দু বিয়ে হোক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের উপহার সংস্কৃতি, সবখানেই সোনা এক সম্মানের প্রতীক। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় মানুষ যখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পায়, তখন তারা ভরসা রাখে সোনার উপর। এটাই সোনাকে অন্য যেকোনো পণ্য থেকে আলাদা করে।

স্বর্ণ কখনো শুধু ধাতু ছিল না—এটা ছিল রাজপ্রাসাদের গর্ব, যুদ্ধের লুট, কিংবা প্রেমের প্রতীক। ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়, রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মোগল দরবার—সবখানে স্বর্ণের ছিল অবিসংবাদিত আধিপত্য।

স্বর্ণের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, উদ্বেগ, আর জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন, “স্বর্ণের দাম এত বাড়ছে কেন?”, “এখন কিনবো, না আরও কমার অপেক্ষা করবো?”, “২১ ক্যারেট না ২২ ক্যারেট, কোনটা লাভজনক?”এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারেন বিস্তারিত, তথ্যভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতানির্ভর আজকের লেখায়। এই লেখাটি আপনাকে স্বর্ণ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে এবং আপনি নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

স্বর্ণের দাম এত বেশি কেন? স্বর্ণের দাম কেন এত বেশি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কেবল সৌন্দর্য বা ঐতিহ্যের দিক থেকে নয়, অর্থনীতির দিক থেকেও বিষয়টি দেখতে হয়।

সোনা এমন একটি মূল্যবান ধাতু, যার সরবরাহ সীমিত কিন্তু চাহিদা সবসময়ই বেশি। ঠিক এই কারণেই সোনার দাম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উচ্চ পর্যায়ে থেকেছে। সোনার প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয় কীভাবে?

স্বর্ণের প্রকৃত দাম বা সোনার দাম কত হবে তা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারেই ঠিক হয়। লন্ডন বুলিয়ন মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন (LBMA) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ বাণিজ্য বাজারে প্রতিদিন সোনার দাম ওঠানামা করে।

বাংলাদেশে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS) আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর ভিত্তি করে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে। এছাড়াও, স্বর্ণের ক্যারেট অনুযায়ী দামের পার্থক্য হয়। যেমন ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম সবসময় ২১ ক্যারেটের চেয়ে বেশি।

স্বর্ণ উৎপাদনের জটিলতা ও খরচ : স্বর্ণের দাম কেবল চাহিদার কারণে বেশি নয়, উৎপাদনের জটিলতা ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াও এর একটি বড় কারণ। পৃথিবীর খুব অল্প কিছু দেশে বড় আকারে সোনা খনন করা হয়। যা অনেক গুলো ধাপ পার করে বিক্রির জন্যে প্রস্তুত করা হয়, যেমন:

মাটির গভীর থেকে স্বর্ণ আহরণ, প্রসেসিং ও পরিশোধন (Refining) এবং পরিবহন ও সংরক্ষণের খরচ এসব মিলিয়ে এক ভরি স্বর্ণ বাজারে পৌঁছাতে প্রচুর খরচ হয়। তাই প্রাকৃতিকভাবেই এর দাম উঁচুতে থাকে।

সোনার চাহিদা বনাম সরবরাহ : অর্থনীতির একটি সাধারণ নিয়ম হলো—চাহিদা যত বেশি, সরবরাহ যত কম, দাম তত বেশি।
স্বর্ণের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে বিশেষত ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশে স্বর্ণ কেনার প্রবণতা বেশি

কিন্তু পৃথিবীর স্বর্ণখনি থেকে আহরণ সীমিত : এই চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা স্বর্ণের দাম ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার ওপর বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি আর বৈদেশিক মুদ্রার দরপতনের কারণে মানুষ টাকা না রেখে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এতে স্বর্ণের চাহিদা আরও বেড়ে যায় আর দামও বাড়তে থাকে।

বর্তমানে স্বর্ণের দাম বাড়ছে কেন? যদি আপনি নিয়মিত বাজারের খবর রাখেন, তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে সাম্প্রতিক সময়ে স্বর্ণের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অনেকে ভাবছেন, এটা কি সাময়িক বৃদ্ধি, নাকি দীর্ঘমেয়াদে সোনার দাম আরও বাড়বে? আসলে এর পেছনে রয়েছে কিছু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাজারভিত্তিক কারণ, যা বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের দামে প্রভাব ফেলছে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা : বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক অনিশ্চিত সময় পার করছে। কোভিড পরবর্তী মন্দা, বাণিজ্যযুদ্ধ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, সবকিছু মিলিয়ে মানুষ তাদের অর্থ সুরক্ষিত রাখার উপায় খুঁজছে।

এই সময় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না গিয়ে স্বর্ণে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ মনে করছেন। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা হয় “safe haven investment”, অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়। এই প্রবণতাই স্বর্ণের দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) : যখন বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, তখন টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ, আজকের ১০০০ টাকা দিয়ে যেটা কেনা যাচ্ছিল, কয়েক মাস পর সেটা কিনতে আরও টাকা লাগবে।

এই অবস্থায় মানুষ চায় এমন একটি সম্পদ, যার মূল্য সময়ের সাথে কমে না, স্বর্ণ তার সেরা উদাহরণ।
তাই মুদ্রাস্ফীতি যত বাড়ে, স্বর্ণের দামও তত বাড়ে। কারণ মানুষ টাকা না রেখে সোনায় বিনিয়োগ করে, ফলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

বৈদেশিক মুদ্রার দরপতন (বিশেষ করে মার্কিন ডলার) : স্বর্ণের দাম মূলত মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয়। যখন ডলারের মান কমে যায়, তখন অন্য দেশের ক্রেতাদের জন্য স্বর্ণ তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে যায়, ফলে তারা বেশি কেনেন। এই অতিরিক্ত চাহিদা আবার সোনার দামকে উপরে ঠেলে দেয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমে গেলে স্বর্ণ আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, যা ভ্যন্তরীণ বাজারে দামের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বৈশ্বিক রাজনৈতিক টেনশন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা—এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক সংকটের সময় স্বর্ণের দাম প্রায় সবসময়ই বাড়ে। কারণ মানুষ অন্য বিনিয়োগ থেকে সরে এসে সোনায় টাকা রাখে।

বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে স্বর্ণের দাম আজকের বাজারে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারন

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে

ডলারের সংকট ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি

স্থানীয় বাজারে জুয়েলারি চাহিদা বৃদ্ধি

এই সব মিলিয়ে স্বর্ণের দাম বর্তমানে কত হবে তা প্রায় প্রতিদিনই পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS) প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দাম আপডেট করছে।

সংক্ষেপে বলা যায়, স্বর্ণের দাম বাড়ছে কারণ এটি এখনো নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক, যেখানে অর্থনীতি অস্থির, ডলারের মান কমছে, আর বিশ্ব রাজনীতি অনিশ্চিত।

২১, ২২, ১৮ ক্যারেট ও শনাতন সোনার দামের পার্থক্য

বাংলাদেশে গয়না কেনার সময় সবচেয়ে সাধারণ প্রশ্নগুলো হলো :

২১ ক্যারেট না ২২ ক্যারেট নিব?

শনাতন সোনার দাম কেন কম?

১৮ ক্যারেট সোনা কি ভালো?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে আগে বুঝতে হবে, ক্যারেট মানে কী এবং প্রতিটি ধরণের সোনার পার্থক্য কোথায়।

ক্যারেট মানে কী?

সোনার বিশুদ্ধতার পরিমাণ নির্ধারণের একক হলো ক্যারেট (Karat)।

২৪ ক্যারেট = ১০০% বিশুদ্ধ সোনা

ক্যারেট যত কমে, ধাতব মিশ্রণ তত বাড়ে

গয়না তৈরিতে সাধারণত ১৮, ২১, ও ২২ ক্যারেট সোনা ব্যবহৃত হয়। ২৪ ক্যারেট সোনা খুব নরম হওয়ায় এটি সাধারণত মুদ্রা বা বার আকারে রাখা হয়, গয়না তৈরিতে নয়।