বাহাত্তরের সংবিধান সংস্কার করে হলেও রেখে দেওয়ার কথা যারা বলে, তাদের চিন্তা ‘অত্যন্ত ক্ষতিকর’ বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কেন নতুন সংবিধান রচনা না করে সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছেন, সেই প্রশ্নও তিনি রেখেছেন।
গত ১৮ জুলাই শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘জুলাই নেটওয়ার্ক’ আয়োজিত ‘সংবিধানের ফাঁদ- সংবিধান ও গণসার্বভৌমত্ব নিয়ে জরুরি বয়ান’ শীর্ষক ‘শহীদ আবু সাঈদ-ওয়াসিম স্মারক বক্তৃতায়’ তিনি এ বিষয়ে কথা করেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, “যারা বলেন ৭২ এর সংবিধান সংস্কার করা যায়, তাদের সঙ্গে আমি একমত না। তাদের চিন্তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তারা মূলত দিল্লির আধিপত্য এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির আধিপত্যকে পুনবার্সিত করতে চায়।
“ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির মানে হল, নতুন করে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ গঠন করা। যে বাংলাদেশে এমন একটি গঠনতন্ত্র হবে, যেটা কোনোদিন ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বরদাসত করবে না।”
সংবিধান সংস্কারের কথা যারা বলে, তারা ‘দিল্লির আধিপত্যবাদী রাজনীতিকে’ ধারণ করে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা ওটাই বাস্তবায়ন করতে চায়। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারলে মেনে নেব। আগে সংস্কার কেন চাইছেন? আমি প্রফেসর ইউনূসকে বলতে চাই, আপনি সংস্কার কেন করতে চাইছেন? আমরা কি সংস্কার করতে বলেছি? আপনি সংস্কার করতে বসে জনগণকে বিয়োগ করে দিলেন। জনগণকে মুছে ফেললেন।
“সেই পুরাতন মাফিয়া, লুটেরাদের যারা স্বার্থ রক্ষা করে, তাদের নিয়ে বসে বসে জাতীয় সনদ করবেন? ড. ইউনূস আমাদের জুলাই ঘোষণা দিতে দেন নাই। আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আপনি একটা জুলাই সনদ দেবেন। কই, সে ঘোষণা কোথায়? করলেন কী? জাতীয় ঐক্যমত্য!
“এখন রীয়াজ (আলী রীয়াজ) বলছে, ঐক্যমত্য হচ্ছে না। করলেন কেন এই কমিশন? আমরা তো বলিনি। আমরা নতুন গঠনতন্ত্র চেয়েছি। পুরনো যেসব মানুষ যারা আমাদের পরিচিত যারা জনগণের কথা ভাবেনি তাদের নিয়ে কমিশন করেছেন।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “নতুন সংবিধান সম্পর্কে যখন বলি, তখন অনেকে বলে ফরহাদ মজহার সাহেব ঠিক বলছেন না। আমরা তো সংস্কার করতে পারি। ৭২ সালের সংবিধান আপনি কি বানিয়েছেন? ৭২ এর সংবিধান যারা বানিয়েছে, তারা আইনগতভাবে পাকিস্তানি। তারা পাকিস্তানের সংবিধানের জন্য নির্বাচিত ছিল। তারা স্বাধীন বাংলাদেশে এসে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করেছিল।
“এখন যারা বলে যে আমাদের একটা সংবিধান আছে। কিন্তু আমরা তো সংবিধান প্রণয়ন করিনি কখনো। আপনারা বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান পবিত্র। কেন পবিত্র? কারণ সেটা দিল্লি লিখে দিয়েছে, এজন্য। যারা পাকিস্তান ভেঙে আপনাকে দিল্লির অধীনে নিতে চেয়েছে, তারাই কিন্তু আপনাকে বাহাত্তরের সংবিধান চাপিয়ে দিয়েছে। এখনো হুশ নাই। এখনো বলছেন সংস্কার করবেন। এটা সংস্কার করার সুযোগ নেই।”
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করার অধিকার জনগণের রয়েছে মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন, “এ অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতে। ৭২ সালের সংবিধান কায়েম করতে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।
“বিএনপি নানারকম প্রোপাগান্ডা করে। বিএনপিকে বলি, জিয়াউর রহমান কি ৭২ সংবিধান কায়েম করার জন্য যুদ্ধ করেছেন? তিনি যুদ্ধ করেছেন স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য। সেই ঘোষণায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল। ওখানে সমাজতন্ত্র ছিল? ওখানে ধর্মনিরেপক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল না।”
বিএনপি ৭২ এর সংবিধান চায় কিনা প্রশ্ন রেখে ফরহাদ মজহার বলেন, “আপনারা কি ভারতের দালালি করছেন? কেন এটিকে টিকিয়ে রাখছেন? এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন করে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করার সুযোগ পেয়েছে, এই সুযোগকে নসাৎ করার জন্য প্রথম থেকে তারা বলছে ‘তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন’। আরে ভাই আমরা কি বসছি নির্বাচনের জন্য? শুধু নির্বাচনের জন্য মারা গেলাম, শহীদ হলাম?”
তিনি বলেন, “৫ তারিখ (অগাস্ট) যখন গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল। ৫ তারিখ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন ছিল। নতুন একটা রাষ্ট্র গঠনের সমস্ত কিছু হাজির। মানুষ অকাতরে আত্মাহুতি দিয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা একটা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে, যে কী তারা চায়।
“কী অভিপ্রায় ছিল? ব্যক্তি মর্যাদা এবং অধিকার- এটা কোনো রাষ্ট্র এরপর থেকে আর ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত এমন কোনো আইন রাষ্ট্র করতে পারবে না, যাতে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়। তৃতীয়ত রাষ্ট্র এমন কোনো নীতি বা আইন বানাতে পারবে না, যাতে আমার জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হয়।”
এই তিনটি ঘোষণার ভিত্তিতে নতুন একটা রাষ্ট্র গঠন করবার অভিপ্রায়ে জনগণ শহীদ হয়েছে দাবি করে ফরহাদ মজহার বলেন, “তাহলে কী উচিত ছিল? উচিত ছিল এই যে তথাকথিত সংবিধান আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে আছে ৫০ বছর, এই সংবিধানকে ফেলে দিয়ে আমাদের উচিত ছিল একটা নতুন গঠণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা।
“যেন একটা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারি এবং তার ভিত্তিতে একটা নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে পারি–এটাই ছিল কিন্তু গণঅভুত্থ্যানের ঘোষণা। জুলাই ঘোষণা যেটা বলি আমরা। এটা হল ঘোষণা। তার সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন অবশ্যই যে, যারা খুনি তাদের বিচার। দুর্নীতিবাজদের ধরে নিয়ে আসা। যেসব টাকা পাচার হয়ে গেছে সেগুলো ফেরত নিয়ে আসা। এবং বিচারটা হতে হবে দ্রুত।”
ছয় মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিচার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন, “বিভিন্ন দেশে গণঅভুত্থ্যানের পরে ছয় মাসের মধ্যে বিচার হয়ে গেছে। কারা বিচার করেছে? জনগণ বিচার করেছে। কারা সাক্ষী দিয়েছে? জনগণই সাক্ষী দিয়েছে।
“যারা ক্ষমতায় গেছেন তাদের উচিত ছিল এই ধরনের বিচারের ব্যবস্থা করা। এখন তারা কী করেছেন? শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে ৮ তারিখে গণঅভুত্থ্যানকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সব পুরনো পুলিশ, ব্যবসায়ী, আমলা, সমাজে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে ওই যারা আগে অর্থাৎ যারা নির্যাতন করেছিল তারা আবার এসছে। সেনাবাহিনী সেনাবাহিনীর জায়গায় আছে, আমলারা আমলার জায়গায় আছে, আইন আইনের জায়গায় আছে, আদালত আদালতের জায়গায় আছে। আপনাদের কিছুই বদল হয় নাই।”
তিনি বলেন, “ছাত্ররা বলেছে, একটা জুলাই ঘোষণা দিতে হবে। এই ঘোষণা একইসঙ্গে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের ভিত্তি। এর ভিত্তিতে আগামীদিনের রাষ্ট্র গঠন করা হবে।
“সরকারের ডিসি, ইউএনওরা কি জেলায় জেলায় মানুষের কাছে গিয়ে কখনো আলোচনা করেছেন, একটা গণঅভুত্থ্যান হয়ে গেল আপনারা কেমন রাষ্ট্র চান? করেননি। ফলে জনগণকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হল। গণঅভুত্থ্যান করল জনগণ। অদ্ভুত ব্যাপার। জনগণ কিন্তু বাদ হয়ে গেছে। কারণ ফ্যাস্টিটদের আইন এখনও আছে।”
রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য মানুষ বুঝতে পারে না মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন, “এক বছরও হয় নাই এখনই কিন্তু হাহুতাশ শুরু হয়েছে। এক বছরও হয় নাই গোপালগঞ্জ এসে গেছে। কেন এসে গেছে? এখন আপনি বলবেন, হ্যাঁ সব সরকারের দোষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উনি ঠিকমত কথা বলতে পারেন না, ঠিকমত পুলিশ চালাতে পারেন না। ওখানে গোয়েন্দারা ঠিকমত তথ্য দেয় নাই। সব অন্তর্বর্তী সরকারের
“আর যারা গণঅভুত্থ্যানবিরোধী তারা বলবে, সমস্ত দোষ হল ছাত্রদের। কেন ছাত্ররা গোপালগঞ্জে গেল? আরে ভাই গোপালগঞ্জ কি বাংলাদেশের বাইরে নাকি? যেতে পারবে না কেন? আমি বাংলাদেশের নাগরিক আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারব। কেন ছাত্ররা যেতে পারবে না?”
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “ভুলে যাবেন না, গোপালগঞ্জে জিয়াউর রহমানও যেতে পারেননি। গোপালগঞ্জে এরশাদও যেতে পারেনি প্রথমদিকে। তার মানে আপনারা যদি বোঝেনই গোপালগঞ্জ দেশের বাইরের একটা রাষ্ট্র, এটাই তো আমরা বলছিলাম গণঅভুত্থ্যানের সময়, গোপালগঞ্জ রাষ্ট্রের বাইরের একটা জায়গা।
“গোপালগঞ্জ থেকে সমস্ত পুলিশ নিয়েছে। সেই পুলিশগুলো যারা শেখ হাসিনার আমলে নিয়েছে গুলি-হত্যা করেছে। এরা সবই তো গোপালগঞ্জের। মনে আছে না, একবার খালেদা জিয়া প্রশ্ন করেছিলেন, একবার যখন তাকে বালুর ট্রাক দিয়ে বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করেছিল। ওদের কে বলেছিলেন, ‘কি, তোমরা কি গোপালী?’ এটা কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার শব্দ। কারণ তিনি তো বুঝতে পেরেছিলেন গোপালগঞ্জ একটা বড় ধরনের সমস্যা।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের অন্তর্গত একটা ব্যপার। কিন্তু যদি সেটা ভারতীয় কলোনি হয়ে থাকে, বা বাংলাদেশকে আগামীতে অস্থিতিশীল করবার এবং আবারো শেখ হাসিনা বা ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসিত করবার একটা ঘাঁটি হয়ে থাকে, এটা আগেই আপনাদের ক্লিয়ার করা উচিত ছিল। নাগরিকদের বলা উচিত ছিল।
“যারা নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করে, তারাও দেখি এগুলো লিখতেছে। মানে গণঅভুত্থ্যান হওয়ার পরে ক্রমাগত ছাত্রদেরকে প্রত্যেকটা জায়গায় কীভাবে ছোট করা যায়, কীভাবে দ্রুত গণঅভ্যুত্থানের শক্তিটা নিঃশেষ করে ফেলা যায়। এটা যেমন চলছে, তেমনি ছাত্ররাও একের পর এক তারা ভুল করছে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান। সংবাদসুত্র ওয়েবপোর্টাল বিডিনিউজ২৪.কম