যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে ২০ কোটি ডলারের চুক্তির মধ্য দিয়ে কয়েক মাসের টানাপোড়েনের অবসান ঘটেছে। তবে শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, এটি উচ্চশিক্ষার ওপর সরকারের ‘আক্রমণের’ প্রথম দফা মাত্র।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে হওয়া এ চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনেক বিষয়ে সমঝোতা করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারের নজরদারিও বেড়েছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য অনেক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, এ চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেভাবে অনেক ছাড় দিয়েছে ও সরকারের নজরদারি বেড়েছে, তা ভবিষ্যতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরও একইভাবে চাপ প্রয়োগের নীলনকশা হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের শুরু করা ‘যুদ্ধের’ প্রথম নিশানা হয় নিউইয়র্কের এ বিশ্ববিদ্যালয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিযোগ, ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে যে ইহুদিবিদ্বেষ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে।
এ অভিযোগের পর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাখ লাখ ডলারের ফেডারেল তহবিল হারায়। নতুন গবেষণা অনুদানের জন্য আবেদন করার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণাগারের জরুরি তহবিল স্থগিত হয়ে যায় এবং অনেক গবেষক চাকরি হারান।
তবে গত সপ্তাহে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে ২০ কোটি ডলার দেওয়ার (জরিমানা হিসেবে) ও ইহুদিবিদ্বেষ–সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে সরকারি তদন্ত মীমাংসার জন্য অতিরিক্ত ২ কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধে রাজি হয়েছে।
আমেরিকান কাউন্সিল অন এডুকেশনের সভাপতি টেড মিচেল বলেন, আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর আগেই তহবিল কেটে নেওয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় একপ্রকার ‘টালমাটাল অবস্থায়’ পড়ে গেছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড পোজেন এতে একমত পোষণ করে বলেন, শুরু থেকেই চুক্তিটি যেভাবে সাজানো হয়েছে, তা বেআইনি ও জোরজবরদস্তিমূলক। তিনি চুক্তিটিকে ‘চাঁদাবাজির বৈধ রূপ’ উল্লেখ করে এর কঠোর সমালোচনা করেন।
এ চুক্তির আওতায় শুধু ইহুদিবিদ্বেষের সমাধানই নয়, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি, ভর্তির সময় জাতি-বর্ণের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা ও ক্যাম্পাসে ছেলে–মেয়েদের আলাদা জায়গাসহ কিছু বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সমঝোতা করতে হয়েছে।
চুক্তির আওতায় কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজন স্বাধীন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে রাজি হয়েছে। তাঁর কাজ হলো চুক্তি কার্যকর করা, জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের তথ্য সরকারকে দেওয়া ও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
চুক্তির অনেক শর্তকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ওপর বড় ধরনের হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন পোজেন।
পোজেন বলেন, কলাম্বিয়ায় যা ঘটেছে, তা আসলে নাগরিক সমাজের ওপর এক বড় ধরনের কর্তৃত্ববাদী আক্রমণের অংশ। তাঁর মতে, আইনি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপরও একই ধরনের চাপ তৈরি করা হচ্ছে, যেন তারা সরকারের কথামতো চলে।
পোজেনের আশঙ্কা, আগামী কয়েক সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডসহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ বাড়াবে, যেন তারা কলম্বিয়ার দেখানো পথে চলে।
তবে হার্ভার্ড ইতিমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সরকারি তহবিল কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে আদালতে মামলা করেছে।
তবে হার্ভার্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক স্টিভেন লেভিটস্কি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দিক থেকে কলাম্বিয়ার নজিরটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষামন্ত্রী লিন্ডা ম্যাকমান বলেছেন, কলাম্বিয়ার এ চুক্তি দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ‘নমুনা’ বা মডেল হয়ে উঠবে বলে আশা করেন তিনি।
গত বুধবার ম্যাকমান ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও একটি চুক্তি হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। এ চুক্তির আওতায় কিছু ফেডারেল তহবিল ফেরত দেওয়া হবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত শেষ করা হবে। তবে এর শর্ত হিসেবে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়েছে, তারা ভর্তিপ্রক্রিয়ায় আর জাতি-বর্ণের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারবে না।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা প্যাকসন স্বীকার করেছেন, চুক্তির কিছু শর্ত আগে কখনো ফেডারেল সরকারের পর্যবেক্ষণের অংশ ছিল না। কিন্তু সেগুলো বর্তমান সরকারের জন্য অগ্রাধিকারের জায়গা।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও অভিযোগ মীমাংসায় সরকারকে প্রায় ৫০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ভাবছে বলে শোনা যাচ্ছে।
অন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও সরকারকে খুশি করতে ছোটখাটো ছাড় দিয়েছে। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ট্রান্সজেন্ডার নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই ট্রাম্প পড়াশোনা করেছেন। আর ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈচিত্র্য কর্মসূচির ওপর নজরদারি শুরু হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পদত্যাগ করেছেন।
মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্রেনডন ক্যান্টওয়েল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর এত বড় মাত্রায় সরকারি হস্তক্ষেপ আগে হয়নি। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি।’
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা মনে করেন, চুক্তি করে দ্রুত ফেডারেল তহবিল আবার চালু করাই দ্রুততম উপায়।
তবে ব্রেনডন ক্যান্টওয়েল সতর্ক করে বলেন, ভর্তিপ্রক্রিয়ায় জাতিগত তথ্য সরকারকে দেওয়ার মতো ছাড়কে ভবিষ্যতে ‘অস্ত্র হিসেবে’ ব্যবহার করা হতে পারে ও সরকারের নতুন তদন্তের সুযোগ (বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ঘটনায়) তৈরি করতে পারে।
অধ্যাপক স্টিভেন লেভিটস্কিও একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, একবার ছাড় দিলেই তারা থেমে থাকবে না, তারা আরও ছাড় চাইবে। খুব সম্ভবত এটা প্রথম ধাপ মাত্র।
অধ্যাপক ডেভিড পোজেন মনে করেন, ছোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সঠিক অবস্থান বজায় রাখা আরও কঠিন হবে। কারণ, ছোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফেডারেল তহবিলের ওপর কম নির্ভরশীল।
তবে এখনো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে শক্তভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন লেভিটস্কি। তিনি বলেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা কঠিন, কিন্তু আমাদের এটা করতেই হবে। এটা একটা নজিরবিহীন আক্রমণ। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’