১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আমেরিকানদের হাতে সময় আছে মাত্র ৪০০ দিন

আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে ফিরেছি এক প্রবল উদ্বেগ নিয়ে। ফেরার সময় আমার মনে হয়েছে আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রেমীদের হাতে দেশটির গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই শুরু করার জন্য আর মাত্র ৪০০ দিন হাতে আছে। আগামী বছরের শরতে যদি এমন এক কংগ্রেস গঠিত হয়, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার লাগাম টানতে পারবে, তাহলেই নির্বাহী ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের প্রস্তুতির জন্য পরের ৭০০ দিন কাজে লাগানো যাবে। এটাই এই প্রজাতন্ত্রকে রক্ষার একমাত্র পথ। এর নাম দেওয়া যেতে পারে ‘আমেরিকান গণতন্ত্র রক্ষার অভিযান’—প্রথম ধাপ ও দ্বিতীয় ধাপ।

এটাকে কি বাড়াবাড়ি বা আতঙ্ক ছড়ানো বলা যায়? আমার মনে হয় না। কারণ, গত গ্রীষ্মে সাত সপ্তাহ আমেরিকায় কাটিয়ে আমি দেখেছি ট্রাম্প কী ভয়ানক গতিতে ও নির্মমতায় দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ভেঙে দিচ্ছেন। আরও হতাশাজনক ব্যাপার হলো তাঁর বিরুদ্ধে সেখানে প্রতিরোধ প্রায় নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে, একবার কোনো উদার গণতন্ত্র ভাঙতে শুরু করলে সেটিকে পুনর্গঠন করা প্রায় অসম্ভব। ধ্বংস করা সহজ, কিন্তু নতুন করে গড়া ভীষণ কঠিন।

তাই দল বা মত যা–ই হোক, সব গণতন্ত্রপন্থীরই এখন কামনা করা উচিত—২০২৬ সালের ৩ নভেম্বর প্রতিনিধি পরিষদ ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে ফিরুক। ডেমোক্র্যাটদের নীতি বা নেতৃত্ব নয় (যা নিজেই দুর্বল ও এলোমেলো); বরং গণতন্ত্রের স্বার্থেই তা ফিরুক। সংবিধান কংগ্রেসকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী করেছে। কিন্তু রিপাবলিকানরা (যাঁরা এখন ট্রাম্পের ভয়ে ও প্রভাবে বন্দী) যতক্ষণ দুই কক্ষই নিয়ন্ত্রণে রাখবে, ততক্ষণ সেই দায়িত্ব পালিত হবে না।

অনেকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে তিরিশের দশকের ইউরোপের কর্তৃত্ববাদী উত্থান বা হাঙ্গেরির ভিক্তর অরবানের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশলের তুলনা করছেন। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমেরিকার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন নির্বাহী শাখার অতিরিক্ত ক্ষমতা, নির্বাচনী সীমানা কারসাজি, রাজনৈতিক সহিংসতার গভীর শিকড়, আর এক স্বৈরশাসককে সহায়তা করে এমন চরম পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি।

আমেরিকায় প্রেসিডেন্টের অতিরিক্ত ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তা ছিল। বিপ্লবী যুদ্ধের নায়ক প্যাট্রিক হেনরি সংবিধান অনুমোদনের বিরোধিতা করেছিলেন এই আশঙ্কায়, কোনো একদিন কোনো অপরাধী প্রেসিডেন্ট কার্যত ‘আমেরিকার সিংহাসনে’ বসে পড়তে পারেন। পরে ২০ শতকে দুই দলের প্রেসিডেন্টই ধীরে ধীরে সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের অস্পষ্ট ‘নির্বাহী ক্ষমতা’ আরও বাড়াতে থাকেন।

সাম্প্রতিক সময়ে রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্টও এই ক্ষমতার ব্যাপক ব্যাখ্যা দিয়ে ‘ইউনিটারি এক্সিকিউটিভ থিওরি’র পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এখন ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৭ সালের মতো অপ্রস্তুত নয়। এই বাড়তি ক্ষমতা ও ফাঁকফোকর নির্মমভাবে কাজে লাগাচ্ছে তারা। তারা এখন আইন ভাঙছে, আদালতের রায় মানছে না।

একইভাবে নির্বাচনী সীমানা কারসাজির সমস্যাও বহু পুরোনো। ‘গেরিম্যান্ডারিং’ (নির্বাচনী এলাকার সীমানা এমনভাবে কারসাজি করা, যাতে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বাড়তি সুবিধা পায়) শব্দটি চালু হয়েছিল ১৮১২ সালে। কিন্তু আজকের বিভক্ত আমেরিকান রাজনীতিতে এটা নতুন মাত্রা পেয়েছে।

২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা দেয়, তারা দলীয় গেরিম্যান্ডারিং ঠেকাতে পারবে না, শুধু বর্ণভিত্তিক কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। এর ফল হলো এখন ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে টেক্সাসে এমনভাবে সীমানা বদলানো হচ্ছে, যাতে রিপাবলিকানরা পাঁচটি অতিরিক্ত আসন পায়। জবাবে ক্যালিফোর্নিয়া বলছে, তারাও পাল্টা কারসাজি করে ডেমোক্র্যাটদের পাঁচটি আসন বাড়াবে। অর্থাৎ নির্বাচনের মতো মৌলিক প্রক্রিয়াতেও এখন ন্যায্যতার ভান পর্যন্ত নেই।

সহিংসতা যুক্তরাষ্ট্রে এতটাই সাধারণ হয়ে গেছে যে ইউরোপের কোনো দেশ তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। প্রায় প্রতিদিনের খবরেই কোনো না কোনো সহিংস অপরাধের খবর থাকে। আর তার সঙ্গে ভয়াবহ স্কুলে গুলিবর্ষণের ঘটনা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্রের সংখ্যা মানুষের চেয়ে বেশি। ফ্রান্স রাজনৈতিক নাটক উপভোগ করে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নাটক হলো ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে জনতার হামলা।

সম্প্রতি আবার ডানপন্থী কর্মী চার্লি কার্ককে গুলি করা হয়েছে। হত্যাকারীর পরিচয় প্রকাশের আগেই ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বামপন্থীরাই হত্যাকারীদের দল’। আর ট্রাম্প দায় চাপালেন ‘চরম বামপন্থীদের ঘৃণা ছড়ানো বক্তৃতা’র ওপর।

এ অবস্থায় যদি দেশটি ষাটের দশকের মতো রাজনৈতিক সহিংসতার নিম্নগামী চক্রে না পড়ে, তবে তা এক অলৌকিক ঘটনাই হবে। অথচ ট্রাম্প চাইলে এটিকে অজুহাত করে ১৮০৭ সালের ইনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট জারি করতে পারেন, যাতে সেনা রাস্তায় নামানো যায় এবং জরুরি অবস্থার নামে আরও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা যায়।

এসবের মধ্যেই সবচেয়ে হতাশাজনক হলো প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা। বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায়ী নেতা, আইন সংস্থা, গণমাধ্যম, প্রযুক্তিজগৎ—কারও পক্ষেই সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব হয়নি। কেউ চুপ করে থেকেছে, কেউ লজ্জাজনকভাবে মাথা নত করেছে। আবার কেউ কেউ প্রেসিডেন্টকে খুশি করার চেষ্টা করেছে, যেমন মার্ক জাকারবার্গ। কেন? কারণ, সবাই মুক্তবাজার প্রতিযোগিতার যুক্তিতে চলে এবং প্রতিশোধের ভয়ে থাকে। আমি কখনো ভাবিনি আমেরিকার মতো দেশে ভয় এত দ্রুত এবং এত বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোটার দমন ও অযোগ্য ঘোষণার চেষ্টা, আর ট্রাম্পের ডাকযোগে ভোট নিষিদ্ধ করার হুমকি। ফলে আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়েই প্রশ্ন। কাজেই সব গণতন্ত্রপন্থীর দায়িত্ব হলো নির্বাচন যতটা সম্ভব সুষ্ঠু করার চেষ্টা করা। আর ডেমোক্র্যাটদের দায়িত্ব হলো এসব বাধা সত্ত্বেও জয়লাভ করা।

২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কিন্তু আপাতত গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রথম নিয়মই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মধ্যবর্তী নির্বাচনে গণতন্ত্রীদের জিততেই হবে। টিমোথি গার্টন অ্যাশ দ্য গার্ডিয়ান-এর কলাম লেখক, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ।