রাহেনুর ইসলাম : যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটও খেলে? ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সহ-স্বাগতিক নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেরই মনে হয়েছিল কথাটা। ক্ষমতাধর এই দেশটি অলিম্পিকে রাজত্ব করলেও সেখানে ক্রিকেটে আগ্রহ আলোকবর্ষ দূরের ব্যাপার।
ইতিহাস অবশ্য বলছে অন্য কথা। ১৮৭৭ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম টেস্ট খেলে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। তবে সেটাই কি প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ? না, বিস্ময়কর হলেও প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে, ভেন্যু নিউইয়র্ক।
১৮৪৪ সালে ২৪ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ম্যানহাটনের সেন্ট জর্জেস ক্রিকেট ক্লাবে মুখোমুখি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডা। ১০০০ ডলারের প্রাইজমানির ম্যাচটা ২৩ রানে জিতেছিল ক্যানাডা। পরের বছর ক্যানাডা সফর করে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট দল। এরপর দুই দলের সিরিজের নামকরণ হয় ‘কে.এ. অটি কাপ’ যার শুরু অ্যাশেজেরও বহু আগে।
এমন ঐতিহ্য থাকলেও ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে। ক্ষমতাধর দেশটিতে ক্রিকেটের প্রসারে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে সহ-স্বাগতিক করা হয়েছে তাদের। বিশ্বকাপের দূত হিসেবে যুবরাজ সিং, ক্রিস গেইল, উসাইন বোল্টও খেলাটার প্রচারণা চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
স্বাগতিক হিসেবে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ক্যানাডাও প্রথমবার খেলছে এই বিশ্বকাপে। প্রতিবেশী দেশ দুটি পড়েছে আবার একই গ্রুপে।
দল বেড়ে ২০
ওয়ানডে বিশ্বকাপে দল কমিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে আইসিসি। মাত্র ১০ দল নিয়ে খেলা হয় মর্যাদার এই বিশ্বকাপ। শক্তিতে পিছিয়ে থাকা ‘ছোট’ দলগুলোর নিজেদের মেলে ধরার পরিসরটাও ছোট হয়ে আসে তাই।
এজন্যই ২০০৭ সালে ১২ দল নিয়ে শুরু হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪ হয় ১৬ দলের। টানা চার আসর ১৬ দল নিয়ে খেলার পর এবার পরিধি বেড়েছে আরও, অংশ নিচ্ছে রেকর্ড ২০টি দল।
নেপাল, উগান্ডা, ক্যানাডা, নামিবিয়ার মতো দলগুলো বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ পেয়েছে তাই। প্রথমবার এই ফরম্যাটের বিশ্বকাপ খেলছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও উগান্ডা। ২০১৪ সালের পর ফিরেছে নেপাল। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ, অ্যামেরিকা মহাদেশের পিছিয়ে পড়া দলগুলো সুযোগ পাওয়ায় টুর্নামেন্টটা হয়ে উঠেছে সত্যিকারের বিশ্বকাপ আর বৈচিত্র্যপূর্ণ।
ছোট দলগুলোকে হারাতে হারাতে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়ে ফেলেছিলেন উগান্ডার অধিনায়ক ব্রায়ান মাসাবা (রেকর্ডটা কিছুদিন আগে ভেঙেছেন পাকিস্তানের বাবর আজম)। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি ৩১৪ রানের ইনিংসটা নেপালের। গত এশিয়ান গেমসে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে রেকর্ডটা গড়েছিল তারা। আইসিসি এবারের বিশ্বকাপে দল না বাড়ালে সেই উগান্ডা আর নেপালকে হয়ত অপেক্ষা করতে হতো আরও। ছোট এই দলগুলো এবার বিশ্বকাপ খেলবে বড় কীর্তি গড়ার স্বপ্নে। তাতে আরও রোমাঞ্চকর ও উপভোগ্য হওয়ার কথা বিশ্বকাপের।
শুরুর আগেই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা
সব বিশ্বকাপেই ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের উত্তেজনার পারদ চড়ে অনেক। এবারও ব্যাতিক্রম হয়নি। কিন্তু এই ম্যাচের ভেন্যু নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম প্রস্তুত ছিল না বিশ্বকাপের ৪০ দিন আগেও! ৩৪ হাজার দর্শক আসনের স্টেডিয়ামটির মাঠে ছিল না ঘাসের চিহ্ন। পিচ তো অনেক পরের কথা!
রোমাঞ্চকর এক অভিযাত্রায় সময় মতোই সম্পন্ন হয়েছে সব। নিউইয়র্ক শহরের পূর্বে প্রায় ২৫ মাইল দূরের এ ভেন্যুটিকে বলা হচ্ছে ক্রিকেটের প্রথম ‘মডিউলার’ স্টেডিয়াম। স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি অস্থায়ী এই স্থাপনাকে চাইলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতেও নিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এই স্টেডিয়ামে স্থাপন করা হয়েছে ফর্মুলা ওয়ানের লাস ভেগাস গ্রাঁ প্রিঁর অস্থায়ী গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড। পপুলাস নামের একটি স্থাপত্য ফার্ম ডিজাইন করেছে নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের। যুক্তরাষ্ট্রের ৩টি ভেন্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮টি ম্যাচ হবে এই মাঠেই। অথচ সেখানে ঘাস লাগানো শুরু হয়েছিল ২৯ এপ্রিল থেকে!
১ জুন ভারতের সঙ্গে এই মাঠে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। ১০ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এখানেই বিশ্বকাপের মূল টুর্নামেন্টের ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। আর ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচটি হবে ৯ জুন।
পিচের জন্য ১৪ হাজার মাইল পাড়ি
নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে খেলা হবে ড্রপ-ইন পিচে। এই মাঠের জন্য প্রায় ১৪ হাজার মাইল বা ২২ হাজার ৫৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পিচ আনা হয়েছে অ্যাডিলেড থেকে। পিচগুলো তৈরি করেছে ‘অ্যাডিলেইড ওভাল টার্ফ সলিউশন্স।’
এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভালের প্রধান কিউরেটর ড্যামিয়ান হাউ। গত অক্টোবরে হাউ ১০টি পিচ তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে এগুলো ট্রেতে বসানো হয়। প্রতিটি পিচকে ভাগ করা হয়েছে দুটি ট্রে-তে। সব মিলিয়ে ম্যাচ খেলার মতো ৪টি ও অনুশীলনের জন্য আরও ৬টি পিচ প্রস্তুত করেন তিনি।
অ্যাডিলেডে বানানো পিচগুলো জাহাজে করে প্রথমে এসেছে ফ্লোরিডায়। এরপর সড়কপথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিউইয়র্কে । অত্যাধুনিক ক্রেন দিয়ে মূল মাঠে বসানো হয়েছে চারটি পিচ। অনুশীলনের জন্য ছয়টি পিচ স্থাপন করা হয়েছে অনুশীলন মাঠে।
পিচের আচরণ নিয়ে ড্যামিয়েন হাউ বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য ছিল গতি ও সমান বাউন্স থাকবে, এমন পিচ তৈরি করা যেখানে খেলোয়াড়রা শট খেলতে পারবেন। আমরা বিনোদনদায়ী ক্রিকেট চেয়েছি তবে চ্যালেঞ্জ থাকবে এখানে।”
এবারের ফেভারিট
বলা হয় ক্রিকেটের দৈর্ঘ্য যত কম, প্রতিদ্বন্দ্বিতা তত বেশি। এজন্যই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো মারকুটে দলকে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। গত বিশ্বকাপে নামিবিয়ার মতো ‘পুচকে’ দল হারিয়েছিল ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে। তাই বিশ্বকাপে হট ফেভারিট বলার উপায় নেই কাউকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে হওয়া ২০১০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ক্রিকেট উপভোগও করে ইংলিশরা। তাই ব্রায়ান লারার মতো কিংবদন্তি পিটিআইয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেমিফাইনালে দেখছেন ইংল্যান্ডকে। তবে ফাইনালে লারার ফেভারিট ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন আবার এগিয়ে রাখছেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এসএ২০ ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের কাঠামোর জন্য তার ফেভারিট প্রোটিয়ারা, যদিও পরিসংখ্যান বলছে এখনও কোনও বিশ্বকাপের ফাইনালেই পৌছেনি রংধনুর দেশটি।
ইংল্যান্ডের বেটিং সাইটগুলোর ফেভারিট আবার ভারত। তাদের পক্ষে বাজির দর ৪.০। আর দ্বিতীয় ফেভারিট অস্ট্রেলিয়ার বাজির দর ৫.০। গত কয়েকটি সিরিজের ফর্ম বিচারেই এমন রেটিং। অস্ট্রেলিয়া সবশেষ খেলা সিরিজে হারিয়েছে নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর পাকিস্তানকে। আবার অস্ট্রেলিয়াকে সহজে হারিয়েছে ভারত। এই অঙ্কেই বাজিকরদের ফেভারিট রোহিত শর্মার দল।
দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবা বাবর আজম-শাহিন শাহ আফ্রিদিদের পাকিস্তানকেও হিসাবের বাইরে রাখার উপায় নেই। বাংলাদেশ অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে চোখ রেখে গেছে বিশ্বকাপ খেলতে। বিসিবির ভিডিওতে অবশ্য তাওহিদ হৃদয় বলেছেন, শিরোপা স্বপ্নের কথা।
সবমিলিয়ে উন্মুক্ত এই বিশ্বকাপ নতুন চ্যাম্পিয়ন পাবে নাকি পুরোনো চ্যাম্পিয়নরাই বাজিমাত করবে-সেটাই দেখার।
তারার মেলা
আইপিএল, পিএসএল, এসএ২০, বিগব্যাশ মাতানো বেশিরভাগ ক্রিকেটারই রয়েছেন এবারের বিশ্বকাপে। আইপিএল কোয়ালিফায়ারের আগে ২০১.১৩ স্ট্রাইক রেটে ৫৩৩ রান করা হায়দরাবাদের অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটার ট্রাভিস হেডের উপর বিশ্বকাপে নজর থাকবে আলাদা করে। অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ডেভিড ওয়ার্নাররা ছন্দে নেই তবে বিশ্বকাপের যে কোনও ম্যাচের রং বদলে দেওয়ার সামর্থ্য আছে দুজনেরই।
ভারতের বিরাট কোহলির টি-টোয়েন্টিতে স্ট্রাইক রেট নিয়ে সমালোচনা হয়েছে যথেষ্ট। তবে এবারের আইপিএলে গ্রুপ পর্বে ১৫৫.৬০ রেটে সর্বোচ্চ ৭০৮ রান তারই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১১৪১ রানও কোহলির। ভারতের সূর্যকুমার যাদবের সঙ্গে তরুণ যশস্বী জয়সওয়াল, শিভম দুবেরা যেমন ব্যাট হাতে বিশ্বকাপ মাতাতে পারেন তেমনি বোলিংয়ে জাসপ্রিত বুমরা, কুলদীপ যাদবরাও ঘোরাতে পারেন ছড়ি।
একইভাবে বিশ্বকাপ মাতানোর অপেক্ষায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল, দক্ষিণ আফ্রিকার এইডেন মারক্রাম-কাগিসো রাবাদা, আফগানিস্তানে রশিদ খান, শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, পাকিস্তানের শাহিন শাহ আফ্রিদি-বাবর আজম, ইংল্যান্ডের জস বাটলার-ফিল সল্টরা। গত দুই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট পাওয়া হাসারাঙ্গারও চ্যালেঞ্জ তৃতীয়বার রেকর্ডটা ধরে রাখার (২০২১ সালে ১৬ আর ২০২২-এ পান ১৫ উইকেট)।
ছোট দলের বড় তারকা হয়ে উঠতে পারেন ৯ বলে ফিফটি করা নেপালের দীপেন্দ্র সিং আইরি, আয়ারল্যান্ডের পল স্টার্লিং, নামিবিয়ার ডেভিড ভিসেরা। নিউজিল্যান্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া কোরে অ্যান্ডারসনের ওপরও নজর থাকবে আলাদা করে। টি-টোয়েন্টির মারকুটে ব্যাটার না হলেও আলো কাড়তে পারেন বাংলাদেশের তাওহিদ হৃদয়, জাকের আলিরাও।
সাকিব-রোহিতের ৯ নং
সেই ২০০৭ থেকে টানা বিশ্বকাপ খেলে চলেছেন সাকিব আল হাসান ও রোহিত শর্মা। এই দুজন এবার খেলবেন ক্যারিয়ারের রেকর্ড টানা নবম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধকল, ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের চাপ আর ইনজুরি সামলে ৯টা বিশ্বকাপ খেলা-এক কথায় অবিশ্বাস্য।
৩৬ ম্যাচে সাকিবের রান ৭৪২ আর উইকেট ৪৭টি। এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের কীর্তিটা সাকিবেরই। আগের আট বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার ম্যাচ ৩৯টি, যা এই টুর্নামেন্টের রেকর্ড। ৯ ফিফটিসহ তিনি করেছেন ৯৬৩ রান।
নবম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া সাকিব-রোহিত কি পারবেন টুর্নামেন্টটা রঙিন করতে? – রাহেনুর ইসলাম সাংবাদিক, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলের সৌজন্যে