কফিহাউজ গানটি নিয়ে মান্না দে সবসময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দেন গীতিকার সুরকারকে। তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। তার মতে, হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হতো আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি। তবে মান্না দে এ গানটির দ্বিতীয় অংশ হিসেবে ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ শীর্ষক একটি গান প্রথম গানটির ঠিক কুড়ি বছর বাদে গেয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যময় কারণে সেটি শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাঙালি। কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির গীতকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতার পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। এই গানটির জন্ম কাহিনীটি বেশ গল্পের মতো। সময়টা ১৯৮৩ সাল। গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরী প্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরী প্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা। সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরী প্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরী প্রসন্ন মজা করেই বলেন, `কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ? এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, `কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো। ` এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে? সুপর্ণ এবার বলে, কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো। গৌরী প্রসন্ন এবার বলেন, তোমার বাবা (নচিকেতা ঘোষ) কি আর সে গান গাইবেন? তর্ক চলছে বটে কিন্তু গৌরী প্রসন্ন এরই মধ্যে মনে মনে তৈরি করে ফেলেন দুটি লাইন। এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই। ’ সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা। কিন্তু গানের বাকি লাইনগুলো?
পরের দিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন । সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন। তখনই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরী প্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক। শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে। ’ কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস। তবে কফি হাউসের দ্বিতীয় অংশ হিসেবে পরবর্তী সময়ে ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ নামে একটি গান রেকর্ড করেছিলেন মান্না দে। একটি নতুন রেকর্ড কোম্পানিই রেকর্ড করিয়েছিল গানটি। কিন্তু সুপর্ণকান্তি জানিয়েছেন, সেই গানের অরিজিনাল স্পুলটি পাওয়া যায়নি। ফলে অন্য স্পুল দিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। নিখিলেশ, মইদুলদের নিয়ে দ্বিতীয় গানটি লিখেছিলেন শমীন্দ্র রায় চৌধুরী। প্রথম গানের স্কেলেই গানটা করেছিলেন মান্না দে। দ্বিতীয় গানটি প্রথমটির থেকেও সুরের বৈচিত্রের বিচারে অনেক ভাল হয়েছিল। কিন্তু কোথায় গেল সেই স্বপ্নের কফি হাউস কেউ জানে না। মান্না দেও হতাশ। তিনি শুধু বলেছেন, বাঙালি তো জানতেই পারল না সেই গানের কথা। কফি হাউজ নিয়ে মান্না দের দুটি গান আছে। দুটি গান এখানে তুলে ধরা হল বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য… শিল্পী- মান্না দে কথা- গৌরী প্রসন্ন মজুমদার সুর- সুপর্ণ কান্তি ঘোষ কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই আজ আর নেই………………………। ।
নিখিলেশ প্যারিসে মইদুল ঢাকাতে নেই তারা আজ কোন খবরে গ্র্যান্ড এর গীটারিষ্ট গোয়ানিস ডি সুজা ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে কাকে যেন ভালবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে পাগলা গারদে আছে রমা রায় অমলটা ধুক্ছে দুরন্ত ক্যান্সারে জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়। । সুজাতাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তার হীরে আর জহরতে আগা গোড়া মোড়া সে গাড়ী বাড়ি সব কিছু দামি তার আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ সান্যাল বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকতো আর চোখ ভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে ডি সুজাটা বসে শুধু থাকতো। । একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘণ্টা চারমিনার ঠোঁটে জ্বলতো কখনো বিষ্ণুদে কখনো যামিনী রায় এই নিয়ে তর্কটা চলতো রোদ ঝড় বৃষ্টিতে যেখানেই যে থাকুক কাজ সেরে ঠিক এসে জুট্তাম চারটেতে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম। । কবি কবি চেহারা কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ মুছে যাবে অমলের নামটা একটা কবিতা তার কোথাও হলোনা ছাপা পেলো না সে প্রতিভার দামটা অফিসের সোসালে এমেচার নাটকে রমা রায় অভিনয় করতো কাগজের রিপোর্টার মইদুল এসে রোজ কি লিখেছে তাই শুধু পড়তো। । সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায় কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়। ।
কফি হাউজ-২ স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই নিখিলেশ লিখেছে প্যারিসের বদলে এখানেই পুজোটা কাটাবে কী এক জরুরি কাজে ঢাকার অফিস থেকে মইদুলকেও নাকি পাঠাবে একটা ফোনেই জানি রাজি হবে সুজাতা আসবেনা অমল আর রমা রায় আমাদের ফাঁকি দিয়ে কবেই তো চলে গেছে ওদের কখনো কি ভোলা যায়? স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই ওরা যেন ভালো থাকে একটু দেখিস তোরা শেষ অনুরোধ ছিল ডিসুজার তেরো তলা বাড়িতে সবকিছু আছে তবু কিসের অভাব যেন সুজাতার একটাও তার লেখা হয়নি কোথাও ছাপা অভিমান ছিল খুব অমলের ভালো লাগে দেখে তাই সেই সব কবিতাই মুখে মুখে ফেরে আজ সকলের স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই নাম যশ খ্যাতি আর অনেক পুরস্কার নিখিলেশ হ্যাপি থেকে গিয়েছে একটা মেয়ে বলে সুজাতা বিয়েতে তার দুহাত উজার করে দিয়েছে সবকিছু অগোছালো ডিসুজার বেলাতে নিজেদের অপরাধী মনে হয় পার্ক স্ট্রীটে মাঝরাতে ওর মেয়ে নাচে গায় ইচ্ছে বা তার কোন শখে নয় স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই কার দোষে ভাঙলো যে মইদুল বলেনি জানি ওরা একসাথে থাকেনা ছেলে নিয়ে মারিয়ম কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ আর কারো খোঁজ রাখেনা নাটকে যেমন হয় জীবন তেমন নয় রমা রয় পারেনি তা বুঝতে পাগলা গারদে তার কেটে গেছে শেষ দিন হারালো সে চেনা মুখ খুঁজতে স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই দেওয়ালের রঙ আর আলোচনা পোস্টার বদলে গিয়েছে সব এখানে তবুও প্রশ্ন নেই, যে আসে বন্ধু সেই আড্ডা তর্ক চলে সমানে সেই স্বপ্নের দিনগুলো বাতাসে উড়িয়ে ধুলো হয়ত আসছে ফিরে আজ আবার অমলের ছেলেটার হাতে উঠে এসেছে ডিসুজার ফেলে যাওয়া সে গীটার স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই, আজ আর নেই জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই, আজ আর নেই।। (তথ্যসূত্রঃ গুগল, ছবিঃ গুগল) সংগৃহীত