১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ট্রাম্পের ধাক্কায় হতভম্ব মোদি যে কঠিন শিক্ষা নিচ্ছেন

মুডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতের শাসকশ্রেণি ভেতরে-ভেতরে খুশিই হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে প্রকাশ্যে ও আড়ালে ‘কিং ডোনাল্ড’-কে খুশি করার চেষ্টা করতেন, তাতে মনে হয়েছিল, এই দুই ডানপন্থী ‘দানবের’ মধ্যে বিশেষ রসায়ন তৈরি হয়েছে।

কিন্তু ট্রাম্প যখন শুল্ককে অস্ত্র বানিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও ভূরাজনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে শুরু করলেন, তখন ভারত বেকায়দায় পড়ে। ভারত ব্যতিব্যস্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় বসেছিল। তবে দিল্লি জানত, এসব আলোচনা সহজ হবে না; কারণ কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের কঠিন শর্ত ছিল। তারপরও আশা ছিল, ভারতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্র মাথায় রাখবে এবং চীনের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে দেশটি তার কৌশলগত প্রয়োজন মেনে নিয়ে একটা ভালো চুক্তি করবে।

কিন্তু হলো উল্টোটা। ট্রাম্প প্রথমে এপ্রিল মাসে ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসালেন, যা কিনা অনেক মার্কিন মিত্রদেশের ওপর আরোপিত শুল্কের চেয়েও অনেক বেশি। এরপর শাস্তি হিসেবে সেই হার দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করা হলো। এর কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বলা হলো, ভারত ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ার তেল কিনে তা শোধন করে আবার রপ্তানি করছিল। এই নতুন শুল্কহার ভারতের সব অ-মুক্তপণ্যের (নন–এক্সেম্পট) মার্কিন বাজারে রপ্তানি প্রায় অপ্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। এর মানে দাঁড়ায়, ভারত থেকে যেসব পণ্য মার্কিন বাজারে রপ্তানির সময় শুল্কছাড় পায় না (মানে যেগুলো অ-মুক্তপণ্য), সেসব পণ্যের ওপর এখন নতুন করে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

শুল্কের বাইরেও আরও বিষয় আছে। এপ্রিল মাসে পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের ঘটনায়ও ট্রাম্প ও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারত ও পাকিস্তানকে এমনভাবে তুলে ধরলেন, যেন দেশ দুটি ঝগড়াটে প্রতিবেশী এবং মার্কিন হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। ট্রাম্প পরে জোর দিয়ে বললেন, তিনি টেলিফোনে হুমকি দেওয়ার কারণেই ভারত ও পাকিস্তান লড়াই বন্ধ করেছে। এতে ভারত ও পাকিস্তানকে একই কাতারে ‘অশান্ত ঝামেলাবাজ’ হিসেবে দাঁড় করানো হলো। এটি ভারতের জন্য ছিল ভীষণ অপমানজনক। ফলে ভারত ট্রাম্পের এসব দাবি অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্প ভারতীয় রপ্তানির ওপর যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছিলেন, তার আসল কারণ ছিল অন্য। তাঁরা মনে করেন, ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব নিতে চেয়েছিলেন; তিনি চেয়েছিলেন সবাই তাঁকে শান্তির নায়ক মনে করুক এবং এর মাধ্যমে তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পথ সুগম হোক। কিন্তু ভারত তাঁকে সে কৃতিত্ব দিতে চায়নি এবং সে কারণেই তিনি মোদির ওপর খেপে গিয়ে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।

ট্রাম্প শুরুতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, এটা ভারতের ওপর শাস্তিমূলক আঘাত। তিনি ভারতকে ‘মৃত অর্থনীতি’ বলে উপহাস করেছেন এবং তাঁর প্রধান বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো অভিযোগ তুলেছেন, ভারত সস্তায় রাশিয়ার তেল কিনে মুনাফা করছে, অর্থাৎ যুদ্ধ থেকে দিল্লি লাভ তুলছে। এমনকি ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘মোদির যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

এই লজ্জাজনক সম্পর্কচ্ছেদ মোদির এক দশকের পরিশ্রমে তৈরি করা ‘বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত রাষ্ট্রনায়ক’ ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিনি যে উদ্যম নিয়ে বিদেশি নেতাদের জড়িয়ে ধরতেন আর বাড়াবাড়ি রকমের বন্ধুত্ব দেখাতেন, এখন সেসব হাস্যকর মনে হচ্ছে। তবে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের এই মোড় কেবল দুই ক্ষমতাবান নেতার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখলে ভুল হবে।

ভারত বড় দেশ; তার ভূরাজনৈতিক অবস্থান একদিনে বদলানো সহজ নয়। শীতল যুদ্ধের সময় ভারত পুঁজিবাদী ব্লক বা সমাজতান্ত্রিক ব্লকে—কোনোটাতেই যোগ দেয়নি। এটাকেই তখন বলা হয়েছিল জোটনিরপেক্ষ নীতি (নন-অ্যালায়েনমেন্ট)। মোদির আমলে এই শব্দটা খুব একটা জনপ্রিয় নয়, কারণ শব্দবন্ধটি নেহরুর সময়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তবে মোদির পররাষ্ট্রনীতি আসলে একই রকম। মোদির নীতি হলো ভারতকে বহু-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া। এখন এই নীতিকে বলা হচ্ছে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ (স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি)। তবে ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ আর ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর লক্ষ্যটা একই।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ভারত রাশিয়া থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল কিনছে, সেটা শোধন করে আবার ইউরোপে রপ্তানি করছে। বাইডেন প্রশাসন বিষয়টা জানত, তবু চুপ ছিল। এটাকেই ভারতের ‘দুই দিক সামলানোর ক্ষমতা’র প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।

গত ২৫ বছরে ভারতের রাজনীতিক শ্রেণি যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। শাসকশ্রেণির সন্তানদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যতের স্বপ্নও জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।

মনমোহন সিংয়ের (যিনি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি করেছিলেন) আমল থেকেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। পরে কোয়াড (যেখানে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে আছে) গঠিত হয় চীনকে ঠেকানোর জন্য। এটাকে সবার কাছে ভারতের পশ্চিমমুখী ঝোঁকের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়।

এই ঝোঁক ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে একধরনের অদ্ভুত ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। বাইরে থেকে দেখা যায় ভারত ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ মেনে চলে, কিন্তু আসলে সে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকেছে। ভারত এমন সব জোট করেছে, যেগুলো পুরোপুরি জোট নয়, সম্পর্কও খুব ঘনিষ্ঠ দেখানো হলেও ভেতরের আসল ভিত্তি ততটা মজবুত নয়। মোদির শাসনামলে নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছিলেন, ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি আর প্রবৃদ্ধির হার এতটাই বড় যে এখন ভারত বিশ্বের শীর্ষ শক্তিগুলোর টেবিলে বসার যোগ্য হয়ে গেছে।

কিন্তু আসল কথা হলো—ভারত না এত ধনী, না পশ্চিমা দেশগুলোর মতো শ্বেতাঙ্গ, না পুরোপুরি ইংরেজিভাষী। তাই আসল সত্যটা হলো, পশ্চিমা দুনিয়ার বা অ্যাংলো-আমেরিকান ব্লকের ভিআইপি ক্লাবের স্থায়ী সদস্য হওয়ার মতো জায়গায় ভারত এখনো পৌঁছায়নি। মোদির কর্মকর্তারা ভুলে গিয়েছিলেন, পশ্চিমের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের আসল কোনো ‘মিত্র’ নেই; তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, ওখানে সবাইকে ‘ক্লায়েন্ট’ বা নির্ভরশীল দেশ হিসেবে দেখা হয়।

ট্রাম্প ভারতের ওপর বাড়তি শুল্ক বসালেন একেবারে রাগ করে। এটা আবারও মনে করিয়ে দিল, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা অনেক সময় ভারতকে হয় ভিখারি নয়তো ঝামেলাবাজ হিসেবেই দেখে এসেছেন। অনেকে বলেন, ট্রাম্প আসলে অন্য রকম নেতা। তাই তিনি যেভাবে ভারতকে নিয়ে ঝগড়া করছেন, সেটা সাময়িক। যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্ক এত গুরুত্বপূর্ণ (অর্থনীতি ও রাজনীতির কারণে) যে, এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন খারাপ থাকবে না। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা উল্টো। ট্রাম্প আসলে সেই সত্যটা বলে ফেলেছেন, যা অন্য পশ্চিমা নেতারা ভব্যতার খাতিরে এত দিন মুখে আনতে পারেননি।

পশ্চিমা দেশগুলো সব সময় ভারতকে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই সাহায্য ছিল তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার কৌশল। এখন জলবায়ু পরিবর্তন আর চীনের উত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে, পশ্চিমাদের ক্ষমতা চিরকাল টিকবে না। তার ওপর তাদের অর্থনীতিও আর আগের মতো বাড়ছে না। তাই তারা ধীরে ধীরে সেই নিয়মকানুন আর ব্যবস্থাগুলো থেকে সরে আসছে, যেগুলো একসময় নিজেরাই বানিয়েছিল এবং অন্যদের মানতে বাধ্য করেছিল। গাজা হলো এই পরিস্থিতির সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিদেশি সাহায্য, শরণার্থী আইনি ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, জাতিসংঘ—সবকিছু এখন তারা অগ্রাহ্য করছে। দরিদ্র ও অস্থির বিশ্ব থেকে নিজেদের বাঁচাতে ধনী দেশগুলো নিজেদের চারপাশে সুরক্ষা বলয় তৈরি করছে।

ফলে পশ্চিমা দেশগুলোয় উগ্র ডানপন্থী দলগুলো দ্রুত বাড়ছে। ট্রাম্প-ঘরানার নেতারা সামনে আসছেন। নাইজেল ফারাজ, জর্ডান বারদেলা, অ্যালিস ভাইডেল, ভিক্টর অরবানের মতো নেতারা দেখাচ্ছেন, ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদ ও সুরক্ষাবাদ অমোচনীয়। ভারতের মতো অ-পশ্চিমা দেশগুলোকে এ ধরনের বাস্তবতাকে দীর্ঘ সময় ধরে মোকাবিলা করতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ইউরোপীয় নেতারা শুধু ট্রাম্পকে খুশি করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেকে ছোট করতেও রাজি আছেন।

পশ্চিমা উদারপন্থীরা যত সমালোচনা করুক না কেন, ট্রাম্প যেদিক নেতৃত্ব দেবেন, ইউরোপ তা অনুসরণ করবে। ট্রাম্পের শুল্ক শুধু খেয়ালি বিষয় নয়। এটা ইঙ্গিত। সে ইঙ্গিতের মানে হলো—পশ্চিমারা নিজেদের চারপাশে দেয়াল বানাচ্ছে। ভারতের আগের প্রধানমন্ত্রীদের মতো মোদিও শিখছেন—ভূগোলকে এড়িয়ে সামনে যাওয়া যায় না। আর জোটনিরপেক্ষ থাকাটা ভারতের কোনো পছন্দের বিষয় নয়; এটা আদতে তার জন্য বাধ্যতামূলক বিষয়। মোদি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ভারতের অবস্থান বিশ্বের মানচিত্রে দেশটিকে অনেক সময় কঠিন এবং সীমিত বিকল্পের সামনে দাঁড় করায়।

মোদি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ভারত কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মতো সমানতালে দাঁড়াতে পারবে না। আবার ট্রাম্পের কাছে ইউরোপের মতো মাথা নত করেও থাকতে পারবে না। তাই ভারতকে বাধ্য হয়ে এক দড়ির ওপর হাঁটতে হবে। একটি বৈরী বিশ্বকে মোকাবিলা করতে করতে তাকে একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে দুলতে হবে। দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, মুকুল কেশবন ভারতীয় ইতিহাসবিদ, ঔপন্যাসিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।