১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দক্ষিণ কোরিয়া: আত্মহত্যার শীর্ষে, জন্মহারের তলানিতে

উন্নত প্রযুক্তি, কে-পপ তারকা, চোখ ধাঁধানো নাটক আর রোমান্সে ভরা কোরিয়ান ড্রামা—এইসব দিয়েই আজ দক্ষিণ কোরিয়াকে চেনে বিশ্ব। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, যেনো এক স্বপ্নের দেশ, যেখানে সবাই সুন্দর, সফল আর হাসিখুশি। কিন্তু পর্দার এই সুখী কোরিয়ার আড়ালেই রয়েছে এক নিঃসঙ্গ, ক্লান্ত আর বিষণ্ন সমাজ। গ্ল্যামারস আউটার শেল ভেদ করে ভেতরে তাকালে দেখা যায়, এ যেন আরেকটি কোরিয়া—চাপ, হতাশা আর হারিয়ে ফেলার ভয় যেখানকার প্রতিদিনের সঙ্গী।

দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশুরা খেলা শেখে না, শেখে লড়াই করতে। মাত্র চার বছর বয়সেই শুরু হয় কঠিন এক প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাজীবন। বড় বড় প্রবন্ধ লিখতে শেখে ১৫ মিনিটে। খেলাধুলা কিংবা আনন্দের সময় নেই বললেই চলে। দিনের বেলায় স্কুল, আর রাতে গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশন—এভাবেই চলে কিশোরদের জীবন।

বাবা-মা মনে করেন, সন্তান যত বেশি পড়বে, তত বেশি সফল হবে। তাই অঙ্ক, ইংরেজি, সাহিত্য থেকে শুরু করে শিল্পকলা পর্যন্ত সবকিছুতেই ‘পারফেক্ট’ হতে হয়। ফলে শিশুর মনেও ঢুকে পড়ে এক ভয়ংকর বার্তা—“তোমাকে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে, নইলে তুমি ব্যর্থ।”

এই অমানবিক প্রতিযোগিতার চাপে আজ বিপর্যস্ত কোরিয়ার তরুণ সমাজ। হতাশা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা—এসব যেন এখন নিত্যদিনের অনুভূতি। আত্মহত্যার হারে কোরিয়া এখন বিশ্বের শীর্ষে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন আত্মহত্যা করছেন। প্রতি লাখে মৃত্যুর হার ২৮.৩ জন—একটি উন্নত দেশের জন্য ভয়ংকর এক পরিসংখ্যান।

এত চাপ, এত দুঃখের মাঝেও মানুষ সন্তান আনবে কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার ভয়াবহ জন্মহার। বর্তমানে দেশটির গড় জন্মহার মাত্র ০.৭ শতাংশ, যা বিশ্বে সবচেয়ে কম। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হার অব্যাহত থাকলে ২১ শতকের শেষে কোরিয়ার জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে যাবে। এমনকি ২০৬০ সালের দিকে দেশটি একপ্রকার ‘বৃদ্ধদের দেশ’ হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চামড়ার রঙ, মুখের গঠন, চোখের আকার—এসবের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়িত হন কোরিয়ার মানুষ। কোরিয়ায় সুন্দর হওয়াটা শুধু সৌন্দর্যের ব্যাপার নয়, বরং চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত। অনেক অভিভাবক সন্তানদের কলেজ পাশের উপহার হিসেবে প্লাস্টিক সার্জারির খরচ দিয়ে থাকেন। একজন তরুণীর জীবনে সৌন্দর্য এমন গুরুত্ব পায় যে, প্রতি তিনজনের একজন কোরিয়ান নারী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেকে ‘নতুন করে’ গড়ে তোলেন।

চাকরির ক্ষেত্রেও মুখের সৌন্দর্য বড় ভূমিকা রাখে। এজন্য কিছু প্রতিষ্ঠান একসময় ইন্টারভিউয়ের সময় মুখ দেখা নিষিদ্ধও করে দেয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়, কোরিয়ার সমাজে বাহ্যিক সৌন্দর্যের কতটা মূল্য।

সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করা যেন কোরিয়ানদের জীবনের নিয়ম হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, অবসর—এসব শব্দ কেবল অভিধানেই টিকে আছে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, কোরিয়ানরা বছরে গড়ে ১,৯১৫ ঘণ্টা কাজ করেছেন, যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর গড় সময়ের চেয়ে প্রায় ২০০ ঘণ্টা বেশি। এর ফলে কাজের চাপে ক্লান্ত শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ।

ন্যাশনাল হেলথ ইনস্যুরেন্সের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যেই এখন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, গাউট আর আর্থ্রাইটিসের মতো ‘বুড়োদের রোগ’ বেড়ে চলেছে।

বাইরে থেকে যতটা ঝলমলে, ভেতরে ততটাই ছাইচাপা আগুন দক্ষিণ কোরিয়া। তরুণরা এক অদৃশ্য চাপের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি, বিনোদন আর উন্নয়নের দাপটের আড়ালে এ দেশটি যেন হারিয়ে ফেলেছে তার মানবিক আত্মাকে।