বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জ্বর-সর্দির উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ১০ জনের মধ্যে ছয়জনই এ ভাইরাসে আক্রান্ত। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ানো এ ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) যৌথ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে ১৯টি হাসপাতালে জ্বর-সর্দির উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নেওয়া এক হাজার ৪৫৩ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতি মাসে ওইসব হাসপাতালের তথ্য হালনাগাদ করা হয়।
রাজধানীর আইসিডিডিআর,বি কার্যালয়ে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকার ভূমিকা: ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী কর্মশালায় জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। গত ১ ও ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কর্মশালায় চিকিৎসক, নীতিনির্ধারক, গবেষক ও ওষুধ শিল্পের প্রতিনিধি অংশ নেন।
জরিপের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের হার ছিল ২৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল জুন মাসে– ৩৭ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে সংক্রমণের হার ছিল ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৭ সালের পর থেকে এটিই এক মাসে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার।
কর্মশালায় জানানো হয়েছে, মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের গুরুতর অসুস্থতা ও সাড়ে ছয় লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসায় ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকাকে জাতীয় ক্লিনিক্যাল নির্দেশনায় অন্তর্ভুক্ত করার জোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কর্মশালার দ্বিতীয় দিনে আইইডিসিআর,বির পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, ২০০৭ সাল থেকে পরিচালিত ইনফ্লুয়েঞ্জা নজরদারি কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ইনফ্লুয়েঞ্জা জটিলতার কারণে পরে নিউমোনিয়া, ফুসফুসে প্রদাহ, সাইনাস ইনফেকশন, শিশুদের ক্ষেত্রে মধ্যকর্ণের ইনফেকশন, দীর্ঘমেয়াদি অ্যাজমা বা হাঁপানি দেখা দেয়। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে হার্টের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ মৌসুমি এবং এটি প্রতিবারই মূল্যবান জীবন কেড়ে নিচ্ছে। সময়মতো টিকা দিলে বহু মৃত্যু ও গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধ সম্ভব।
তিনি বলেন, টিকাদান শুধু কার্যকর নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী। বিশেষ করে দেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে টিকার টেকসই প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যকর্মীরাও ঝুঁকিতে : আইসিডিডিআর,বির গবেষক ডা. মো. জাকিউল হাসান জানান, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের তুলনায় চার গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে এই সংক্রমণ তাদের সহকর্মী, রোগী ও পরিবারের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবুও এই গোষ্ঠীর মধ্যে টিকা নেওয়ার হার উদ্বেগজনকভাবে কম।
টিকা নেওয়ার পরামর্শ : কর্মশালার বিশেষজ্ঞ প্যানেল আলোচনায় ছিলেন ডা. তাহমিনা শিরিন, ডা. ফেরদৌসী কাদরী, ডা. কে. জামান, ডা. আলী কাওসার ও ডা. ফারহাদ হোসেন। তারা বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকাকে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা নীতিমালায় যুক্ত না করলে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে না। বিশেষ করে সব টিকা বিনামূল্যে– এই ধারণা বাস্তবতাবিবর্জিত এবং পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
প্যানেলের সদস্যরা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশ আর টিকার জন্য আন্তর্জাতিক বিনামূল্য সহায়তা পাবে না। তাই এখনই পরিকল্পনা নেওয়া দরকার, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য টিকাদান ব্যবস্থা টেকসই হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থা ইউএস সিডিসির কান্ট্রি ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. দিমিত্রি প্রিবিলস্কি সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে ভবিষ্যতে যৌথভাবে কাজ করার আশা ব্যক্ত করেন।
সচেতনতা কম, নীতির অভাব : বক্তারা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকাকে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সুপারিশ করলেও বাংলাদেশে এখনও এই টিকার গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম। এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সচেতনতার অভাব, নীতির ঘাটতি, টিকার উচ্চমূল্য, সরবরাহজনিত সমস্যা এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনের বাইরে থাকা। কর্মশালায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়, কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনার সমস্যা, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও গাইডলাইনের অভাব, জনগণের সচেতনতার ঘাটতি– এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুপারিশ করা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য উইংয়ের যুগ্ম সচিব ডা. শিব্বির আহমেদ ওসমানী বলেন, জনসচেতনতা ও টিকাদান কর্মসূচি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।- সমকাল