১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

উত্তেজনা ও মারামারিই যেন আমাদের নিয়তি

গাছ আর মাছ যে এক নয়, সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? আকাশ ও পাতালের ব্যবধান। ও চলে ঊর্ধ্বমুখে; এ চলে নিম্নে। আরও কত কত ব্যবধান দুইয়ের মধ্যে। বৃক্ষ আমরা রোপণ করি; লালন করি যত্নে। তার সঙ্গে কত মৈত্রী আমাদের! জীবনকেও তো বৃক্ষ বলা হয়েছে। তাকে মনে করা হয়েছে বৃক্ষের মতো সজীব, বিকাশমান, মৈত্রীপ্রবণ, সৌন্দর্যবিলাসী। বৃক্ষপাগলেরা পাগল নয়; বিলাসী। তারা পাত্র নয় পরিহাসের কিংবা করুণার। বরঞ্চ দাবিদার উচ্চ প্রশংসার। বিশেষ করে এ যুগে–অভাব ও লোভের কুঠার যখন অত্যন্ত ব্যস্ত বৃক্ষকে নির্মূল করার কর্তব্যে।

মাছের ব্যাপারটা আলাদা। নিচে থাকে; নিম্নমুখী সে। দেখি না, জানি না। তবে এটা জানি, থাকে সে অন্ধকারে। খায় নানা অখাদ্য। গায়ে তার আঁশটে গন্ধ। পচলে আর রক্ষে নেই। কোথায় ফেলব, কত দ্রুত ফেলব তাই ভেবে অস্থির হই। সৌন্দর্য? আছে বোধ করি। যদি রাখা যায় অ্যাকুয়ারিয়ামে। তার বাইরে কতক্ষণ বাঁচে মাছ যে তার সৌন্দর্য দেখব? সরকারি উদ্যোগে যে মৎস্য পক্ষ উদযাপন চলে, তার পোস্টারে লেখা দেখি দুটি স্লোগান– রুপালি মৎস্য সচ্ছলতার উৎস এবং মৎস্য আইন মেনে চলুন মৎস্য সম্পদ রক্ষা করুন। বক্তব্য দুটি আসলেই ভ্রান্ত। কেননা, মাছ রুপালি কি সোনালি, একি আমাদের দেখবার সময় আছে, সরকার মনে করে? রুপালি কি সোনালি দেখলেও দেখি চকিতে, এক নিমেষে। আমাদের চোখ থাকে অন্যত্র। সাইজটা কী, ওজনটা কত, ডিম হবে কী হবে না, টাটকা নাকি বাসি এবং দাম কত; কিনতে পারব কি পারব না। সবটাই রসনার সঙ্গে যুক্ত।

ওইখানে মাছের সঙ্গে পাখির ব্যবধান। পাখির সব কিছুই সুন্দর। তার গান, তার ওড়া দুটোকেই ঈর্ষা করি আমরা। যেমন তার গানের গলাকে, তেমনি তার ওড়ার ক্ষমতাকে। আমাদের নেই। আহা, আমরা যদি পাখি হতাম! গান গাইতাম অনন্তকাল ধরে কিংবা উড়ে যেতাম আকাশের পর আকাশ ভেদ করে। মাছকে ঈর্ষা করে কে? সুন্দর চোখের উপমায় পাখি তো আসেই, এমনকি পটোলও আসে। পটোলচেরা চোখ সে কম ব্যাপার নয় সৌন্দর্যশাস্ত্রে। কিন্তু মাছের মতো চোখ? ও বাবা, সে তো ভয়ানক ব্যাপার। সে-চোখ মৃতের কিংবা ভাবলেশহীন নির্বোধের।

একটু সরে এসেছি। ওই যে পাখিতে-পাওয়া, তাই পেয়েছিল আমাকে। মাছে ফেরা যাক। মাছকে বলেছেন রুপালি, সে-বলাটা নাকচ হয়ে গেল। মাছকে বলেছেন সচ্ছলতার উৎস। মিথ্যা কথা। কার জন্য সচ্ছলতা আনছে মাছ? আমরা যারা মৎস্যপ্রিয়, তারা দাম দিতে দিতে অস্থির। জেলেরা পয়সা করছে মাছ বেচে। তাই বুঝি? কই; জেলেপল্লি তো সে-কথা বলে না। সেখানে পয়সার চেয়ে পয়সার অভাব বেশি প্রকট। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তবু একবার খবর নিয়েছিলেন। উপন্যাস লিখে। আমরা খবরও রাখি না– কী তাদের দশা।

আমাদের এক পাঞ্জাবি গভর্নর ছিলেন। পাকিস্তান আমলে। কী বুঝতে কী বুঝলেন, খুব সরগরম করলেন মাঠঘাট– চাষি ভাই, জেলে ভাই বলে। বোধ করি ধারণা হয়েছিল তাঁর যে, আমরা পূর্ববঙ্গীয়রা ওই দুটো জিনিসই বুঝি, ধান ও মাছ। ভাত দাও, মাছ দাও। ব্যস, হয়ে গেল, আর কিছু চাইবে না। তা নিতান্ত মিথ্যা বলেননি। ওরে বাঙালি, তুই তো পুঁটি মাছের কাঙাল। মাছ-ভাতই তোর আদি, অকৃত্রিম ও নির্ভরযোগ্য খাদ্য। ডাল-ভাত একটা রাজনৈতিক আওয়াজ; তাকে যদি বলতে চান ভাঁওতাবাজি তবে তর্ক করব না। দুধ-ভাতের আশা রাখি না, কিংবা তা সন্তানকেই খাওয়ানো যাবে যদি পাই; ডাল-ভাত নয়, মাছ-ভাত দিন, খেয়ে বাঁচি। মাছ কারও সচ্ছলতা আনবে, এ কথা বলবেন না। ধান যেমন কৃষককে ধনী বানায় না, মাছও তেমনি জেলেকে বড়লোক করবে না। কি রাজনীতিতে, কি সমাজে; কৃষকের তুলনায় বহু বহু গুণ উপেক্ষিত হচ্ছে জেলেরা।

আর ওই যে বলা হচ্ছে– মৎস্য আইন মেনে চলুন; এটাও কোনো কার্যকর বক্তব্য নয়। আইনের প্রসঙ্গ উঠলেই বিপদ। লোকে বেআইনিটা করতে প্রমত্ত হবে। আইন দেখলেই লোকে ক্ষেপে যায় দেখেছি। ভাঙার জন্য লাঠিসোটা খোঁজে। আর সম্পদ রক্ষা করা? কার সম্পদ কে রক্ষা করে? সম্পদ মানেই তো ব্যক্তিগত। একের সম্পদ অপরের জন্য বিপদ। এসব ফেলে সোজা কথা বলা ভালো ছিল। সেটা হলো, আমরা মৎস্যনির্ভর। মাছ ছাড়া আমাদের চলে না, চলবে না। আমাদের বাঙালিত্ব, মনুষ্যত্ব সবই যাবে খারিজ হয়ে। অতএব আসুন, চাষ করি মাছের। নিজে বাঁচি, অন্যকে সাহায্য করি বাঁচতে।

কিন্তু সেটা বলা হবে না। বলা হবে সৌন্দর্যের কথা; বলা হবে সম্পদের কথা। আমাদের সরকারগুলো স্বঘোষিতরূপে জাতীয়তাবাদী। তাই বলে ওই পথে যাবেন না। মাছের ব্যাপারে নয়, গাছের ব্যাপারেও নয়। তারা ব্যস্ত আছেন শাসন করতে। গাছে আগ্রহ নেই, মাছেও আগ্রহ নেই। যেটুকু আছে সবটা লোক দেখানো। তারা কী করবেন যদি পক্ষ পালন না-করা যায়? সরকার যে গাছের পক্ষে নয়, মাছের পক্ষে নয়; তা বোঝা যায় গাছ ও মাছ উভয়কেই তারা ধ্বংস হতে দিচ্ছে দেখে। এই সরকার দিচ্ছে, আগের সরকারও দিয়েছে। মানুষের দরিদ্র আগুন হয়ে জ্বলে উঠে গাছকে পোড়াচ্ছে, কাটছে, বিক্রি করছে। লাকড়ি করে ফেলছে। ওদিকে ব্যবসায়ী গাছকে কাঠে রূপান্তরিত করে ব্যবসা করছে মহাধুমধামে। মাছের আবাস জলা, ডোবা, খাল, বিল, নদী– বাংলাদেশে সবই তো যাচ্ছে শুকিয়ে এবং ভরাট করা হচ্ছে নির্মমভাবে। যেখানে সেখানে বাঁধ, অপরিকল্পিত রাস্তা, বিষাক্ত পতঙ্গনিধক; সবাই মিলে সর্বনাশ ঘটাচ্ছে মাছের। সমুদ্র আছে, উপকূল আছে। কিন্তু সেখানেও মৎস্য সংগ্রহের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। থেকে থেকে শুনি, জলদস্যুরা লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাছ। অসহায় জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ; মানুষই বাঁচাতে পারে না সে মাছ বাঁচাবে কোন জোরে!

আমাদের সরকার পুঁজিবাদ ও মৌলবাদ উভয়েরই পৃষ্ঠপোষক। আর এরা বৃক্ষ ও মৎস্যবিরোধী। পুঁজিবাদ এখন রূপ নিয়েছে মুক্তবাজারের। বাজারের এই মুক্তি গাছকে পরিণত করেছে পণ্যে এবং মাছকে আমদানি-রপ্তানি তথা চোরাচালানের বস্তুতে। মাছ রপ্তানি হচ্ছে; আবার চোরাপথে আসছেও। আসছে ধনীদের জন্য। গরিব মানুষ মাছ খায় না। খাবার স্বপ্ন দেখে। নতুন প্রজন্মের গরিবেরা স্বপ্নেও মাছ দেখবে না। কেবল গল্প শুনবে, যেমন শিশুরা রূপকথা শোনে।

মৌলবাদ প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন। সে ইহজগতে আছে– মনে করে না; ভান করে থাকে আধ্যাত্মিক। এই ছদ্ম আধ্যাত্মিকতা অজুহাত হয়ে দাঁড়ায় উৎপাদনবিমুখতার। মৌলবাদ শ্রম করতে জানে না; তার চাষবাস যতটুকু সবটাই পরকালের। গাছ বোনে না, চাষাবাদে যায় না, পোনা ছাড়ে না ডোবায়। তাই বলে ভোগ যে করে না, তা নয়। মৌলবাদের উৎসাহ আছে মৎস্য-ভক্ষণে। কিন্তু উৎপাদন তো করবেই না; উৎসাহও দেবে না অন্যকে। ওই পথে ডাকবে না; টানাটানি করবে সম্পূর্ণ উল্টোপথে চলার জন্য। উত্তেজনা, মারামারি, কাটাকাটি– এসব নিয়ে ব্যস্ত হবে। আজ যে দেশে মৌলবাদের এমন উৎপাত, তাতেই বোঝা যায় বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থা বড়ই পীড়িত। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।