বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন আলোচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি তারেক রহমান। ১৭ বছর আগে চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার আগে তিনি ছিলেন মূলত মাঠপর্যায়ের রাজনীতির একজন সরাসরি নিয়ন্ত্রক। বিশেষ করে ২০০১ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশজুড়ে তৃণমূল প্রতিনিধি সভার মাধ্যমে দলকে তিনি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন। ২০০৬ সালে জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশে তৈরি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। নানা ঘটনা প্রবাহের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিতে হয় যুক্তরাজ্যে। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে লন্ডনে অবস্থানকালীন তারেক রহমান নিজেকে এক অন্য তারেক রহমান হিসেবে তৈরি করেছেন। বর্তমানের তারেক রহমান অনেক বেশি শান্ত, দূরদর্শী এবং আন্তর্জাতিকভাবে সচেতন। তিনি নিজেকে একজন আধুনিক গণতান্ত্রিক নেতার আদলে গড়ে তুলেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে তারেক রহমান নিজেকে একজন ভিশনারি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। নিজের ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দর্শন এবং কূটনৈতিক দক্ষতায় যে আমূল পরিবর্তন এনেছেন, তা দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষসহ সবার কাছে এক কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়।
মাঠের রাজনীতি থেকে কৌশলগত নেতৃত্ব: বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমল (২০০১-২০০৬) থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হন তারেক রহমান। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব দেন। সারা দেশে ঘুরে ঘুরে তিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তরুণ-যুবকদের ভিশনারি বানানোর চেষ্টা করেন। সে সময়ে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু বিতর্ক উঠলেও তার ভাবমূর্তি একজন ‘পাওয়ারফুল’ সাংগঠনিক নেতা হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সাল পরবর্তী নির্বাসিত জীবনে তিনি নিজেকে একজন পরিপক্ব, দক্ষ এবং কৌশলবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় তিনি সরাসরি রাজপথে থাকতে না পারলেও প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন, যা তার সাংগঠনিক দক্ষতা ও আধুনিকায়নকেই প্রমাণ করে।
সাংগঠনিক সংস্কার ও প্রযুক্তি নির্ভরতা সংশ্লিষ্টরা বলেন, ভিশনারি জাতীয়তাবাদী নেতা হওয়ার প্রচেষ্টার শুরুতেই তারেক রহমান সিন্ডিকেটেড অপপ্রচারের শিকার হন। পরিণতি হিসেবে তাকে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার কোনো ধরনের মামলা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও কারান্তরীণ করে এবং ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। লন্ডনে যাওয়ার পর তারেক রহমান ২০১৩ সালের ২০ মে যুক্তরাজ্য বিএনপির প্রথম কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেন। ২০১৫ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী রূপ দেন তারেক রহমান। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি আদালতের মাধ্যমে তার বক্তব্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। জনগণের কাছে নিজের মতামত পৌঁছাতে তারেক রহমান বিকল্প হিসেবে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও কর্মসূচি প্রণয়ন শুরু করেন।
তারেক রহমান বিএনপির ভেতর ‘পারিবারিক রাজনীতি’র তকমা মুছে ফেলে দলকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন। তিনি ‘জুম’ মিটিংয়ের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত—সবকিছুতেই তিনি এখন ডাটা এবং মাঠপর্যায়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তার এই ‘ডিজিটাল লিডারশিপ’ তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের কাছে বিএনপির আধুনিক ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
লন্ডনে অবস্থান ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ: লন্ডনে অবস্থানকালে তারেক রহমান শুধু রাজনীতি নয়; বরং নিজের শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি লন্ডনে থাকাকালীন আইন ও সমকালীন রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এই পড়াশোনা এবং বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বসবাসের অভিজ্ঞতা তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনেছে। আগের তুলনায় তার বক্তব্যে এখন অনেক বেশি পরিশীলিত, আন্তর্জাতিক রাজনীতির রেফারেন্স এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন দেখা যায়। তার বক্তব্যগুলোয় এখন অর্থনৈতিক সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো প্রধান্য পাচ্ছে।
গত দেড় দশকে তারেক রহমানের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো আন্তর্জাতিক মহলে নিজের ও দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা। দেশের ফেরার কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরা, বিবিসি বা গার্ডিয়ানের মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমে তার বা তার দলের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি কেবল একটি রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী নন, বরং বৈশ্বিক মানদণ্ডের একজন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করছেন।
বিশ্লেষক অভিমত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. স ম আলী রেজা কালবেলাকে বলেন, আমাদের প্রত্যাশা একজন নতুন তারেক রহমান প্রত্যাবর্তন করছেন। এখানে বয়সের পরিপক্বতার ব্যাপার আছে। যথেষ্ট একটা রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে তার চলে যাওয়াটা (লন্ডন) ছিল অস্বাভাবিক। পরবর্তী সময়ে লন্ডনে বসে দীর্ঘদিন তিনি যে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার একটা রিফ্লেকশন (প্রতিচ্ছবি) দল পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু দেখেছি।
তিনি বলেন, এখন একটা নতুন বাংলাদেশে অত্যন্ত অভিজ্ঞ তারেক রহমান, যিনি ১৭ বছর ব্রিটেনের মতো সবচেয়ে বিকশিত গণতন্ত্রের দেশে থেকেছেন। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তার একটা রিফ্লেকশন আমরা দেখতে চাই। কারণ, বাংলাদেশের জন্যে এ মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেক রহমান। তিনি নির্বাচন সামনে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন। এখন উনার জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—দলকে নিয়ন্ত্রণ করা।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক বলেন, ১৭ বছর আগের তারেক রহমান এবং বর্তমান তারেক রহমানের মধ্যে পার্থক্য মূলত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ভাষা ও কৌশলগত অবস্থানে। ভিত্তিগতভাবে নিশ্চিত তথ্য হলো, তিনি দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক বার্তায় সক্রিয় ছিলেন—এটি বিএনপির প্রকাশিত বিবৃতি ও বক্তব্যে প্রতিফলিত। তবে এ অভিজ্ঞতা কতটা বাস্তব মাঠের রাজনীতিতে কার্যকর হবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
দীর্ঘসময় লন্ডনে তারেক রহমানকে পর্যবেক্ষণ করা রয়টার্সের সাবেক সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মাহাবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছরে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোতে সরাসরি অভিজ্ঞতা তারেক রহমানকে ঋদ্ধ করেছে। সে আলোকেই তিনি নতুন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কৃষি, শিক্ষা এবং সামাজিক অবকাঠামোতে উন্নত বিশ্বের মডেলের ছাপ দিতে চান। তার ঘোষিত ৩১ দফায় এসব কিছুর আগাম বার্তা মেলে। ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা’ নিয়ে তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। একজন ভিশনারি নেতা তারেক রহমান এখন হয়ে উঠেছেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্ল্যানার। ঢাকার দৈনিক কালবেলার সৌজন্যে