১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যুক্তরাষ্ট্র

আফগান বিমানঘাঁটি ব্যবহারে তালেবানদের গোপনে চাপ দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

আফগান বিমানঘাঁটি ব্যবহারে তালেবানদের গোপনে চাপ দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু আমরা আফগানিস্তানের জন্য নয় বরং চীনের জন্য বাগরামের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করেছিলাম।’

আফগানিস্তানের বাগরামে অবস্থিত এয়ার বেস তালেবানদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজতে জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনজন ব্যক্তি সিএনএনকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছে।

ট্রাম্প প্রথমবার বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) প্রকাশ্যে সেই আলোচনা উল্লেখ করেন, সাংবাদিকদের বলেন যে তার প্রশাসন বেসটি পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বেসটি কাবুলের প্রায় এক ঘণ্টা উত্তরে অবস্থিত। ২০২১ সালে আফগান সরকারের পতন ও দেশটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান এটি দখল করে। ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এটি (তালেবানকে) বিনা মূল্যে দিয়েছিলাম। আমরা এটিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, ইতোমধ্যেই।’

সূত্রগুলো সিএনএনকে জানিয়েছে, বেসটি আবার মার্কিন নিয়ন্ত্রণে আনার আলোচনা কমপক্ষে মার্চ থেকে চলছিল। ট্রাম্প এবং তার শীর্ষ জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করেন কিছু কারণে বেসটি নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সেসব কারণ গুলো হলো―চীনকে নজরদারিতে রাখা। ওই বেস থেকে চীনের সীমানার দূরত্ব ৫০০ মাইলেরও কম। এছাড়া আফগানিস্তানের বিরল মাটির উপাদান এবং খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার; আইএস-কে লক্ষ্য করে একটি সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্র স্থাপন এবং সম্ভাব্যভাবে একটি কূটনৈতিক সুবিধা পুনরায় খোলা।

তবে এক সূত্র জানান, এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য আফগানিস্তানে পুনরায় মার্কিন সেনা মোতায়েন করতে হবে। আর ট্রাম্প ২০২০ সালে তার প্রথম মেয়াদে তালেবানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে দেশের সমস্ত মার্কিন সৈন্যকে প্রত্যাহারের শর্ত ছিল। তবে বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কীভাবে আলোচনা করছে তা স্পষ্ট নয়। তবে বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন যে তাদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এখনও কিছু প্রভাব রয়েছে।

বাকিংহামশায়ারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এটিকে ফেরত আনার চেষ্টা করছি কারণ তাদেরও (তালেবান) আমাদের কাছ থেকে কিছু প্রয়োজন। আমরা সেই বেসটি ফেরত চাই।’ ট্রাম্প পূর্বেও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ২০২১ সালের মার্কিন সেনা প্রত্যাহার তার প্রশাসনের সময় ঘটলে, তিনি বাগরামের নিয়ন্ত্রণ রাখতেন, এবং এর কৌশলগত গুরুত্ব আফগানিস্তান-চীন সীমান্তের কাছে থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। মাসের শুরুতে তিনি বলেন, ২০২১ সালে বেস থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাইডেন প্রশাসনে ‘বোকামি’ ছিল। ট্রাম্প বৃহস্পতিবার আরও বলেন যে বাগরাম চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের স্থানের কাছে অবস্থিত। এ কথা তিনি মার্চেও বলেছেন।

মার্চে তিনি বলেন, ‘আমরা চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম, কিন্তু আমরা বাগরামের নিয়ন্ত্রণ রাখার পরিকল্পনা করেছিলাম। আর এটি আফগানিস্তানের জন্য নয় বরং চীনের জন্য। কারণ এটি ঠিক সেই স্থান থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। সেখানে চীন তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। আমরা বাগরামে একটি ছোট সেনা বাহিনী রাখার পরিকল্পনা করেছিলাম।’ সিএনএনের প্রতিবেদনে বলছে, ২০২১ সালে জুলাইয়ে আফগানিস্তানে অবশিষ্ট মার্কিন সেনারা বাগরাম এয়ার বেস ত্যাগ করে। প্রায় দুই দশকের জন্য এই বেস আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

দুই মাইল দৈর্ঘ্যের রানওয়েটি দেশের সম্পূর্ণ সামরিক অভিযান পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে যেখানে কার্গো বিমান, যুদ্ধবিমান এবং আক্রমণ হেলিকপ্টারের জন্য পর্যাপ্ত স্থান ছিল। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ. বুশ, বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সকলেই তাদের মেয়াদকালে বাগরাম পরিদর্শন করেছেন। বছরের পর বছর ধরে বেসটি তালেবানের বহু আক্রমণের শিকার হয়েছে। তারা সেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং রকেট হামলাও চালিয়েছে।

মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড সেই সময় বলেছিল যে, ২০২১ সালে যখন মার্কিন সেনারা ঘাঁটি ত্যাগ করে, তখন তারা প্রায় ৯০০টি সি-১৭ কার্গো লোডের সমপরিমাণ জিনিসপত্র সরিয়ে নেয় এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৬ হাজার সরঞ্জাম ধ্বংস করে দেয়। ২০২৩ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রত্যাহারের পরে একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাগরাম ত্যাগের মার্কিন সিদ্ধান্ত সম্ভবত সমগ্র দেশ থেকে অগোছালো মার্কিন প্রস্থানে অবদান রেখেছে, কারণ এর অর্থ ছিল কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর “সম্ভাব্য নন-কম্ব্যাটেন্ট ইভাকুয়েশন অপারেশনের (এনইও) একমাত্র পথ হবে।”

ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, আফগানিস্তানে বর্তমানে ক্ষমতাসীন তালেবানের সম্মতিতে ঘাঁটিটি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিটি কেমন হবে তা পরিষ্কার নয়। যদিও ট্রাম্পের এ পরিকল্পনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাকির জালালি। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক উপস্থিতি থাকতে পারবে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা এক পোস্টে জাকির জালালি লেখেন, আফগানিস্তানের কোনো অংশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে দুই দেশকে যুক্ত থাকতে হবে। ‘পারস্পরিক সম্মান ও অভিন্ন স্বার্থের’ ভিত্তিতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রস্তুত আছে কাবুল।

এদিকে বাগরাম নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের আগে আফগানিস্তানে আটকে থাকা মার্কিনদের নিয়ে কাবুলের সঙ্গে আলাপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। সপ্তাহান্তে তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে কাবুলে সাক্ষাৎ করেন ট্রাম্প প্রশাসনের জিম্মিবিষয়ক বিশেষ দূত অ্যাডাম বোয়েলার ও যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানবিষয়ক সাবেক দূত জালমাই খলিলজাদ। রয়েছে নানামুখী সমস্যা

বাগরাম ফিরে পেতে ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সামরিকভাবে ঘাঁটিটি দখলের কোনো পরিকল্পনা নেই যুক্তরাষ্ট্রের। তবে ঘাঁটিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টায় বড় ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন পড়বে। বাগরাম দখলে নিতে এবং ধরে রাখতে হাজার হাজার মার্কিন সেনার প্রয়োজন হবে। ঘাঁটিটি মেরামত করতেও বহু অর্থের দরকার।

মার্কিন ওই কর্মকর্তার মতে, আফগানিস্তান একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। সেখানে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এই ঘাঁটিতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহও জটিল হবে। এ ছাড়া ঘাঁটিটি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আশপাশের এলাকা নিরাপদ করতে এবং মার্কিন বাহিনীর ওপর রকেট হামলা ঠেকাতে বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন পড়বে। তাই বাস্তবিক অর্থে কীভাবে এটি সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।

তালেবান এখন রাজি না থাকলেও পরে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে যদি বাগরাম ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়, এরপরও ঘাঁটিটি ইসলামিক স্টেট ও আল–কায়েদার হুমকির মুখে থাকবে। হুমকি থাকবে ইরানের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলারও। গত জুনে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারপর কাতারে মার্কিন একটি ঘাঁটি ইরানি হামলার শিকার হয়েছিল।

এমন পরিস্থিতিতে এই ঘাঁটিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওয়াশিংটনের খুব একটা সুবিধা হবে না বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ঘাঁটিটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ফলে যেসব সামরিক সুবিধা পাওয়া যাবে, তা ঝুঁকির তুলনায় কম।