আমাদের ছোটবেলার পৃথিবীটা ছিল বিশ্বাস ও আস্থার। বিশ্বাস ছিল মা-বাবা, ভাইবোন আর আত্মীয়স্বজনের ওপরে; সে আত্মীয়তা যত দূরেরই হোক না কেন। বিশ্বাস ছিল পাড়াপড়শি, মহল্লার বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োকনিষ্ঠদের ওপরে। আজ বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না, আমরা অচেনা মানুষকেও বিশ্বাস করতাম। সেসব আস্থার মূলে ছিল আরও এক গভীরতম বিশ্বাস– মমতার, সহমর্মিতার, যূথবদ্ধতার। অকারণে কেউ অমঙ্গল কামনা করবে না, ক্ষতি করবে না– এই আস্থার।
সমাজে সেই আস্থার জায়গাটি ছিল গভীর, ব্যাপ্ত এবং বিস্তৃত। পরিবারের সবার প্রতি আমাদের আস্থা রাখতাম। অবিমিশ্র আস্থা ছিল বন্ধুত্বের ওপরে; অটল আস্থা ছিল শিক্ষকদের প্রতি। ছোটদের আস্থা ছিল বড়দের প্রতি; অনুসারীদের আস্থা ছিল নেতার প্রতি; সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল শিক্ষিত সমাজের মানুষের প্রতি। এ জাতীয় বিশ্বাস আর আস্থা ছিল সামাজিক সংহতি ও বন্ধনের মূল ভিত্তি। সামাজিক সেই
চিরায়ত বিশ্বাস আর আস্থার কারণেই সমাজে নিরাপত্তার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। শিশু-নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে হতো না; ধর্মীয় সম্প্রীতি হুমকির মুখে পড়ত না।
সমাজে এমনতর বিশ্বাস আর আস্থার কারণে গড়ে উঠেছিল মানুষের প্রতি সম্মান আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বয়োজ্যেষ্ঠরা শ্রদ্ধা পেতেন বয়োকনিষ্ঠদের কাছ থেকে। বয়োকনিষ্ঠরা স্নেহ পেত বড়দের কাছ থেকে। শিক্ষার্থীরা প্রভূত সম্মান করত শিক্ষকদের। সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখত লেখাপড়া জানা মানুষদের। পারস্পরিক সম্মান আর শ্রদ্ধার কারণে মানুষ তার কথা, ভাষায় শালীনতা বজায় রাখত। বজায় রাখত মূল্যবোধের কিছু সীমারেখা।
এর মানে কি উপর্যুক্ত আঙ্গিকে কোনো রকমের ব্যত্যয় ছিল না? অবশ্যই ছিল। কোথাও কোথাও অবিশ্বাস আর অনাস্থা ছিল। কখনও কখনও নিরাপত্তাহীনতারও উদ্ভব হতো। কিন্তু তেমন ঘটনা ছিল স্বল্প এবং ব্যতিক্রমী। তেমন ঘটনায় মানুষ ধিক্কার দিত, যারা তেমন অনভিপ্রেত ঘটনার শিকার তাদের রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং দুর্বৃত্তদের শাস্তি দিত।
আজকে আমাদের এই জগতের চালচিত্র বদলে গেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গড়ে উঠেছে ‘অবিশ্বাসের সংস্কৃতি’। পরিবারের মধ্যে একে অন্যকে বিশ্বাস করে না। যে ভাইবোন মমতা আর ভালোবাসায় ছেলেবেলা কাটিয়েছে, তারাই সম্পত্তির লোভে একে অন্যকে অবিশ্বাস করে; সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আজকের বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তির অংশ নিয়ে অবিশ্বাস আর কলহ সমাজের নানান স্তরে ব্যাপ্ত।
আমরা পড়শিদের বিশ্বাস করি না; অনেক সময় তাদের নামও জানি না, চেনা তো দূরের কথা। আমরা আর পাড়াতুতো অভিভাবকত্বে বিশ্বাস করি না। সে দায়িত্ব কেউ নিতে চাইলে আমরা তাঁকে সোজা করে দিই।
কাজের জায়গায় আমরা সহকর্মীদের বিশ্বাস করি না। ধারণা করি, আমাদের ল্যাং মেরে নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত।
আমরা রাজনীতিতে আর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। আমরা আস্থাহীন সরকার ও রাজনীতিবিদদের প্রতি। সাধারণ মানুষ বহু আগেই আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছে লেখাপড়া জানা মানুষের প্রতি। তিরোহিত আজ বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান। তাদের ওপর চড়াও হওয়া, চড়-চাপড় মারা, নির্যাতনে বয়োকনিষ্ঠদের আজ আর আটকাচ্ছে না। ‘বেয়াদবি’ আজ গ্রহণযোগ্য ভাষা। বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে ‘শিষ্টাচার’ আজ অচেনা মূল্যবোধ। অসম্মান, অপমানের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন শিক্ষকরা। তাদের নানান নির্যাতন, হেনস্তার খবরে সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যম ভরপুর। শিক্ষকদের ন্যূনতম সম্মান ও আস্থার জায়গাটি শিক্ষকরা চিরায়ত কাল ধরে অর্জন করেছিলেন, তা আজ ধূলায় লুণ্ঠিত। কোনো ব্যাপারেই শিক্ষার্থীরা আজ আস্থা রাখতে পারছে না শিক্ষকদের ওপর।
অবিশ্বাস এবং অনাস্থার এই সংস্কৃতি বর্তমান সময়ে বহু অর্গল খুলে দিয়েছে। তার একটি হচ্ছে ভাষা। ভাষা ব্যবহার– লেখা এবং কথায় কোনো সীমারেখা নেই, কোনো শালীনতা নেই, কোনো বাছবিচার নেই। শিক্ষিত বিদগ্ধ মানুষেরা, শিক্ষার্থীরা যেসব শব্দ, বাক্য ব্যবহার করছেন, শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। সভ্যতা-ভব্যতা বলে সেখানে কিছু নেই। সবকিছুই সেখানে চলে। পুরো আঙ্গিক, পরিবেশ একটি বিষাক্ত বলয় সৃষ্টি করেছে, যেখানে অবিশ্বাস, অনাস্থা এবং আঘাত-প্রত্যাঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে মৌলিক খুঁটি।
এই অবিশ্বাস ও অনাস্থার জগৎ গড়ে উঠেছে নানান কারণে। তার একটি হলো মানুষের সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি অর্থ ও ক্ষমতা। মানবিকতা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কোনো কিছুকেই যেন একজন মানুষের অর্জন বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না। যেনতেন প্রকরণে আয়াসহীনভাবে অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করলেই ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা পেলে অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করা সহজ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় তিনটি ব্যাপার ঘটে।
এক. অর্থের অহংকার ও ক্ষমতার কারণে অন্য মানুষকে আর মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয় না। অন্য মানুষকে সম্মান করা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তখন গৌণ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে একটি অবিশ্বাসের আবহাওয়াও তৈরি হয়। যেহেতু আমার অর্থবিত্ত বিপথে অর্জিত, সুতরাং আমার এ চিন্তা মজ্জাগত– অন্যেরা তা নিয়ে নিতে পারে। সে অবস্থায় আমি সদা আশঙ্কিত থাকি, আমার অর্থবিত্ত বেহাত হয়ে যেতে পারে। অবিশ্বাসের ভিত্তিতে যা অর্জিত, তা সংরক্ষণের ব্যাপারেও অবিশ্বাস থাকবে বৈ কি।
দুই. অর্থ ও ক্ষমতা যেখানে জীবনের ভিত্তি, সেখানে আত্মকেন্দ্রিকতা জন্ম নেবে নিশ্চিতভাবে। ‘আমি’ ভিন্ন সেখানে অন্য কোনো কথা থাকবে না। যূথবদ্ধতা সেখানে ঠাঁই পাবে না। একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কখনও অন্য মানুষকে বিশ্বাস করতে ও অন্যের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ অনবরত ভাবতে থাকে, অন্যেরা তাকে প্রতিনিয়ত ঠকাতে ব্যস্ত এবং সেই আত্মকেন্দ্রিক মানুষটির মানসিকতা গড়েই ওঠে অবিশ্বাস ও অনাস্থার ওপর।
তিন. অবিশ্বাস এবং অনাস্থার পথ ধরেই আসে সংঘাত ও সংঘর্ষ। অবিশ্বাস আর অনাস্থার সংস্কৃতি একটি দ্বিমূল অবস্থানের জন্ম দিয়েছে। ‘তুমি আমার সঙ্গে একদম একমত না হলে তুমি আমার শত্রু’– এই অনড় অবস্থানের মাঝখানে আর কিছু নেই। ফলে মানুষে মানুষে সাংঘর্ষিক অবস্থানই বড় প্রকট। সেখানে সহনশীলতা, অন্যের ভিন্নমতের স্বাধীনতা, বুদ্ধি-বিবেচনার মাধ্যমে মতানৈক্যের সমাধানের কোনো সুযোগ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সহিংসতা আমাদের সংস্কৃতি এবং সংঘাত আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেষের কথা বলি, মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে যূথবদ্ধতার কারণে; একে অন্যের ওপর বিশ্বাস আর আস্থার ওপরে ভিত্তি করে। পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের ফলে। সেগুলোকে নষ্ট করলে অবিশ্বাস ও অনাস্থা জন্ম নেয়। খুলে যায় সংঘাত ও সংঘর্ষের দরজা এবং অনিবার্য হয়ে ওঠে ভাঙন ও ধ্বংস। এসব বিষয়ের প্রতি আমরা কি অন্ধ হয়ে থাকতে পারি না, কারণ ‘অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকবে না।’
ড. সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ
বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি। ঢাকার দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে