২৭শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ভারত যেভাবে ট্রাম্পের নোবেল পাওয়ার প্রধান বাধা

২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদ শেষ করার পথে, পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিপুলসংখ্যক মার্কিন নাগরিক, যাঁদের বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী।

হিউস্টনের এনআরজি স্টেডিয়ামে ভারতীয়রা মোদিকে অভ্যর্থনা জানাতে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানের বিরাট আয়োজন করেছিল, যেটাকে বিবিসি বলেছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বিদেশি নেতার সর্ববৃহৎ অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান।’ ৫০ হাজার দর্শক এবং ৪০০ শিল্পীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি ছিল জমজমাট। এই অনুষ্ঠানের নাম বাংলায় বলতে গেলে বলা যায়, ‘মোদি, আপনি কেমন আছেন?’

সেই অনুষ্ঠানে একজন অতিথি ছিলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি স্টেজে উঠে মোদির সঙ্গে কোলাকুলি করে এ সুযোগকে সম্পূর্ণ কাজে লাগালেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারে। ভারতীয়দের বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার চেয়ে ভালো বন্ধু আপনাদের আর কখনো ছিল না।’ করতালিতে কেঁপে উঠল পুরো স্টেডিয়াম। প্রধানমন্ত্রী মোদিও তাঁর নির্বাচনী বই থেকে একটি লাইন টেনে এনে ডাক দিলেন, ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’ বা আরেকবার ট্রাম্প সরকার।

ভারতীয়দের কাছে সেসব দিন ছিল একসময় মধুর স্মৃতি; আর এখন শুধু মরীচিকা। ট্রাম্পকে ভারতীয়রা তাদের সত্যিকার বন্ধু হিসেবে ধরে নিয়েছিল এত দিন। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের স্ত্রী ভারতীয়—এটা নিয়ে ছিল তাঁদের গর্ব।

ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এইচ-ওয়ান ভিসার শর্ত শিথিল করে দিলেন, যেন ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের যুক্তরাষ্ট্রে আসা ও থাকা সহজ হয়। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক যখন প্রথম ঘোষণা করা হয়, ভারতের জন্য রাখা হয়েছিল ২৫ শতাংশ আর বাংলাদেশের জন্য ৫০ শতাংশ। মনে হচ্ছিল, সব ভারতের অনুকূলেই চলছে।
কিন্তু ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্তে সব ওলট–পালট হয়ে গেল। এখন ট্রাম্পের শুল্ক তালিকায় ভারত হয়ে গেল সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। ট্রাম্পকে যাঁরা জানেন, তাঁরা কি আশ্চর্য হয়েছেন?

হঠাৎ ট্রাম্প ভারতের ওপর খুব ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন। ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনে রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাঙা করে রেখেছে। ট্রাম্প মনে করেন, অর্থনীতি ভালো থাকার কারণে রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে চাচ্ছে না।

আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক হয়ে গেল ১৫ আগস্ট। এই বৈঠকে যুদ্ধ বন্ধে সরাসরি কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের পূর্ব বন্ধুত্ব আবার পুনঃস্থাপিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেটি ইউক্রেনের জন্য খারাপ খবর। ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়া খুব বড় শক্তি, যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনের চুক্তি করা উচিত।

ভারতের জন্যও খারাপ খবর আছে। বৈঠকের আগের দিন ট্রাম্পের মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ট্রাম্পের বরাত দিয়ে বলেছিলেন, আলাস্কা বৈঠকে যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয়, ওয়াশিংটন ভারতের ওপর আরোপিত সেকেন্ডারি শুল্ক আরও বাড়াতে পারে। বেচারা নরেন্দ্র মোদি! মনে হয় তিনি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছেন যেখান থেকে নিস্তার পাওয়ার সহজ কোনো উপায় নেই।

চীন হলো রাশিয়ার তেলের বড় ক্রেতা। ট্রাম্প চীনকেও হুমকি দিয়েছিলেন তেল কেনা বন্ধ করতে; কিন্তু চীনকে হুমকি দিয়ে খুব সুবিধা করতে পারেননি; বরং চীনের সঙ্গে একটা সমঝোতা করেছেন। তাই সব চাপ যাচ্ছে ভারতের ওপর। তাঁর ধারণা, অন্তত ভারতের তেল কেনা বন্ধ করতে পারলে রাশিয়া যথেষ্ট কাবু হবে।

ট্রাম্প মনে করেন রাশিয়ার অর্থনীতিকে যদি কাবু রাখা যায়, তাহলে রাশিয়া তাঁর শরণাপন্ন হবে যুদ্ধ বন্ধ করতে। এই দীর্ঘ যুদ্ধ বন্ধ করে ট্রাম্প রাতারাতি বনে যাবেন শান্তির দূত ও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার চূড়ান্ত প্রার্থী। ডোনাল্ড ট্রাম্প নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে তাঁর আকাঙ্ক্ষা ও আচ্ছন্নতা নিয়ে সব সময় সোচ্চার। তিনি এখন ভারতকে তাঁর এই প্রত্যাশার একমাত্র প্রতিবন্ধক মনে করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলেন যে তারা উভয়ে তাদের ‘মৃত অর্থনীতিকে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর মধ্যেই ভূকম্পন শুরু হয়ে গেছে। বিরোধী পক্ষ মোদির অসহায়ত্বের সুযোগে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা আরও ধারালো করেছে।

ভারতের পক্ষে ইচ্ছা করলেও রাতারাতি রাশিয়ার থেকে তেল কেনা বন্ধ করা সম্ভব নয়। রাশিয়া থেকে তারা সস্তা দরে জ্বালানি তেল পায়। ভারত ইরান থেকেও আগে তেল কিনত ভর্তুকি মূল্যে। কিন্তু ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়ি করার পর, ইরানি তেল কেনা বন্ধ করতে হয়েছে। এখন তাদের একমাত্র উৎস রাশিয়া।

ভারত বিশ্বে তেলের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক দেশ। ১৩৫ কোটি লোকের দেশে হঠাৎ জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ বা অনিয়মিত হয়ে গেলে, একটা বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে। এতে ভারতের অর্থনীতিতে যে ধস নামবে, তা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে ভারতের আরও এক দশক সময় লাগবে।

ভারতও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পাল্টা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিন ভারতীয় কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলেছে, নয়াদিল্লি নতুন মার্কিন অস্ত্র ও বিমান সংগ্রহের পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছে।

ট্রাম্পের শুল্কের আরেক বড় ভুক্তভোগী হলো ব্রাজিল। তাদের ওপরও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সেখানে কারণটা ভিন্ন। ব্রাজিল তাদের এক ডানপন্থী ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিচার করছে। কারণ, যিনি নির্বাচনে হেরেও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলেন। ট্রাম্প এই বিচার বন্ধ করতে চান।

শুল্ক কমাবার ব্যাপারে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বলেন, ‘আমি নিজেকে অপমান করব না।’

মোদি চাচ্ছেন ব্রাজিলের লুলা, রাশিয়ার পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আগ্রাসনের বিপক্ষে একটি প্রতিরোধ গঠন করতে। এই মাসেই মোদি চীন যাচ্ছেন। চীন আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক নিয়ে মোটামুটি একটি বোঝাপড়া করে ফেলেছে। তারা এই কোয়ালিশনে যোগ দিলেও খুব সতর্ক থাকবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প নিজ থেকে ছাড় না দিলে লুলা, পুতিন, সি চিন পিং ও মোদি কতটুকু প্রতিরোধ করতে পারেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এদিকে ভারত অন্যভাবে চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে। তারা প্রতিনিধি পাঠিয়ে কথাবার্তাও বলছে ও বিশ্বমঞ্চে তাদের বন্ধুদেরও কাজে লাগাচ্ছে। ভারতের অনেক ব্যবসায়ী এবং মোদির সমর্থকেরা মার্কিন শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য আমেরিকাবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যেমন ম্যাকডোনাল্ড ও কোকা-কোলা থেকে শুরু করে আমাজন, অ্যাপল—এসব যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বয়কট করতে ভারতীয়দের আহ্বান জানাচ্ছে।

ট্রাম্পের বিশ্বে নতুন এক মাতবর হলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাঁর ‘দুর্দান্ত বন্ধু’ বলে অভিহিত করে বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে তিনি মোদিকে ‘কিছু পরামর্শ দেবেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে।’

ট্রাম্প-মোদি শুল্ক সমস্যা নিশ্চয়ই আগামী তিন বছর ট্রাম্পের মেয়াদ পর্যন্ত ঝুলে থাকবে না। কীভাবে সমাধান হতে পারে তার কিছু সম্ভাব্য পথ আমি এখানে তুলে ধরছি।

ক. মোদি, পুতিন, সি, লুলা মিলে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। তাতে ট্রাম্প নমনীয় হবেন।

খ. ট্রাম্প ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় অপরিশোধিত তেল সৌদি আরব বা অন্য কোনো মধ্যপ্রাচ্য দেশ থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারেন। তাতে মোদি পুতিন থেকে সরে আসবেন।

গ. মোদি অনেক দিন ধরে ক্ষমতায়। বিশ্বমঞ্চে তাঁর অনেক বন্ধু রয়েছেন, যেমন নেতানিয়াহু। তাঁরা ট্রাম্পকে বুঝিয়ে ভারতের শুল্ক একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবেন।

ঘ. শান্তির জন্য পরবর্তী নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পর, ট্রাম্প তা পান বা না পান, তিনি আর ইউক্রেনের যুদ্ধ বা শান্তি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তখন ভারত রাশিয়ার থেকে তেল কিনুক বা না কিনুক, তা নিয়ে তাঁর কোনো সমস্যা থাকবে না।

ঙ. মোদি ট্রাম্পকে শান্ত করার জন্য অন্য কোনোভাবে উপঢৌকন দেবেন। যেমন আন্দামান দ্বীপে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করার অনুমতিদান।

আগস্টের ১৫ তারিখে ট্রাম্প ও পুতিন আলাস্কায় বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে মনে হচ্ছে— ট্রাম্প চাচ্ছেন, ইউক্রেন রাশিয়াকে জায়গা ছেড়ে দিক, না হলে তিনি ইউক্রেনকে সাহায্য ও সমর্থন বন্ধ করে দেবেন এবং ইউক্রেন রাজি হলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি হবে। তখন যুদ্ধ থেমে যাবে। এরপর ভারতের ওপর রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধের জন্য আর কোনো চাপ থাকবে না।

এর কোনটাতে যে ট্রাম্পের মন গলবে, তা আগেভাগে বলা সম্ভব নয়। কারণ, ট্রাম্পের অস্থিরতা। তিনি কখন কোন বিষয়ে মনোযোগ দেবেন, তা কেউ বলতে পারবেন না।

আমরা ট্রাম্পকে নিয়ে অনেক কথাই বলি—গ্রিনল্যান্ড দখল, এশিয়ায় ভূরাজনীতি, কানাডার একত্রীকরণ, পাকিস্তানপ্রীতি ইত্যাদি। এর কোনোটাতেই তাঁর কোনো স্থায়ী প্রত্যয় নেই। একবার একটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরে ছুড়ে ফেলেছেন। তবে একটি বিষয় সঠিক—কোনো কাজে তিনি যখন যাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছেন, তার অবস্থা শোচনীয় করে ছেড়েছেন। সালেহ উদ্দিন আহমদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে