১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গোপালগঞ্জে কে হারল কে জিতল?

বুধবার (১৬ জুলাই) যখন গোপালগঞ্জে প্রাণহানির খবর আসছিল, যখন কারফিউ জারি হচ্ছিল, তখন প্রশ্ন উঠছিল– আসলে জিতল কে, আর হারলই বা কে? এনসিপি, না আওয়ামী লীগ? রাজনৈতিক দিক থেকে বিশেষ এই জেলাটিতে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় যদিও চারজনের মৃত্যু হয়েছে, উভয় পক্ষই নিজেদের বিজয় দাবি করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপাতের ওপর দাঁড়িয়ে যে বিজয়, তা আদৌ কি বিজয়? নাকি গণঅভ্যুত্থান- পরবর্তী এই সময়ে এটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার নিদর্শন?

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের কোথাও রাজনৈতিক সমাবেশ বা প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করতে কোনো রাজনৈতিক দলকে আওয়ামী লীগ কিংবা এর অনুসারীদের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। এনসিপি দলও জুলাই মাসের শুরু থেকে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় পদযাত্রা ও পথসভা করে এসেছে। একমাত্র গোপালগঞ্জে গিয়েই হামলা, প্রতিরোধ বা সংঘর্ষের মুখে পড়ল। দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় গোপালগঞ্জে এই ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গোপালগঞ্জ এখনও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কেন্দ্র ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ভিন্নতর অবস্থানের জানান দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত।
বস্তুত গোপালগঞ্জ যেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রতীকী বাস্তবতা। এই জেলা গত সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনার স্বৈর শাসনামলে রাষ্ট্রক্ষমতা, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নিয়েছিল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থ বরাদ্দে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরেই ছিল গোপালগঞ্জ।

গোপালগঞ্জ রাজনৈতিক প্রতীকী শক্তি ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের দৃশ্যমান প্রতিরোধও। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সাম্প্রতিক জেলাটি যেন হয়ে উঠেছিল প্রতীকী দলীয় রাজধানী। দলটির প্রতিনিধিত্ব অনেকাংশে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল এই জেলায়।

এই আলোচনায় খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া ও প্রতীকী প্রতিরোধ প্রাসঙ্গিক। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে তিনি পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। বালুর ট্রাকে রাস্তা বন্ধ করে তাঁকে ঘরবন্দি করে রাখা হয়। তাঁর ক্ষোভে উচ্চারিত কথাগুলো ‘গোপালগঞ্জের নামই থাকবে না’ শুধু ব্যক্তিগত রাগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং তা ছিল এক প্রতীকী প্রতিবাদ। এটি ছিল গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
এই বক্তব্য জনসমক্ষে উচ্চারিত হলেও এর অন্তঃপ্রবাহে ছিল গত দেড় দশকের রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ, যেটি শেখ হাসিনার শাসনের সময়ে গোপালগঞ্জকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এই মন্তব্যকে অনেকেই একটি অঞ্চলের জন্য অবমাননাকর হিসেবে দেখলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া এক নারী বাধাদানকারী নিরাপত্তাকর্মীকে নির্দেশ করে আরও বলেছিলেন, ‘এই যে মহিলা, আপনার মুখটা এখন বন্ধ কেন? বলেন তো কী বলছিলেন এতক্ষণ ধরে? মুখটা বন্ধ কেন এখন? দেশ কোথায়, গোপালি? গোপালগঞ্জ জেলার নামই বদলিয়ে যাবে বুঝছেন? গোপালগঞ্জ আর থাকবে না।’

গোপালগঞ্জে বুধবারের সংঘর্ষ এটাও স্পষ্ট করেছে– এনসিপির মাঠের রাজনীতিতে কৌশলগত দিক বিবেচনায় দুর্বলতা স্পষ্ট। দেশের বৃহত্তর জেলাগুলোতে সফল আয়োজন শেষে গোপালগঞ্জের এই সমাবেশ করা যেত। সমাবেশের আগে উস্কানিমূলক বক্তব্যদানে বিরত থাকলে হয়তো এই সংঘর্ষ এড়ানো যেত। সেনাবাহিনীর সহায়তা ব্যতীত এনসিপির শ্রেষ্ঠত্বের দাবি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে এ ঘটনায় রাজনৈতিক দূরদর্শিতার চেয়ে প্রতিক্রিয়াশীলতার ছাপই বেশি।

অন্যদিকে জুলাই ঐক্যের দুর্বলতাও স্পষ্ট। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর একটি বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল– এই বিপ্লব কি একটি নতুন রাজনৈতিক ঐক্যের জন্ম দিতে পারবে? উত্তরটা এখনও অস্পষ্ট। কারণ বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের মধ্যে এখনও পরস্পরকে সন্দেহ করার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। চরিত্র হনন, জিঘাংসা, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা সবই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিকে ক্ষয়িষ্ণু করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গোপালগঞ্জবাসীর এই প্রতিরোধ সেই বাস্তবতা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

গোপালগঞ্জের প্রতিরোধ আরেকটি বার্তা দেয়– আওয়ামী লীগ এখনও জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে মানতে নারাজ। বোঝাতে চায়, দলটির রাজনৈতিক আধিপত্য ও প্রতিরোধ এখন মুখোমুখি সংঘর্ষে বিস্তার লাভে সমর্থ। গণঅভ্যুত্থানে পরাজয় তারা এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, যা শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনই বিলম্বিত করবে না, বরং জাতীয় রাজনীতিকেও অসহিষ্ণু করে রাখবে।

গত এক বছরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে তা মূলত আত্মরক্ষা ও প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ হিসেবেই প্রতীয়মান। লক্ষণীয়, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারা এখনও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বাস্তবতা এবং এর সামাজিক-রাজনৈতিক অভিঘাত মেনে নিতে পারেনি। যদি একই রাজনৈতিক ধারা ও কৌশল অব্যাহত থাকে, তাহলে দলটির মূলধারায় ফিরে আসা আরও বিলম্বিত হবে।

সব শেষে গোপালগঞ্জের সংঘর্ষ ও রক্তপাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়– প্রতীক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কখনও কখনও বাস্তবের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে– ‘কে জিতল আর কে হারল?’ এই প্রশ্নের উত্তর সংখ্যায় নয়, বরং রাজনৈতিক মূল্যায়ন এবং এর অন্তর্নিহিত বার্তায় নিহিত। যারা আজ জিতেছে বলে উল্লাস করছে, তারা হয়তো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পাবে এই ‘জয়’ পরাজয়ের শুরু মাত্র।

একদিক থেকে দেখলে গোপালগঞ্জে সবাই হেরেছে। কারণ ৪টি মূল্যবান প্রাণ গেছে। তারা দেশের সাধারণ মানুষ। জীবন যখন যায় তখন কেউই জয়ী হয় না। ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: চেয়ারম্যান, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়