১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দশ হাজারেরও বেশি গান কণ্ঠে তুলেছেন সাবিনা ইয়াসমিন

বাংলাদেশের সংগীতজগতের অনন্য নাম সাবিনা ইয়াসমিন। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আধুনিক গান, বিশেষ করে সিনেমার গানে তার কণ্ঠ উপহার দিয়েছেন এ দেশের মানুষকে। তার গাওয়া গান বেজেছে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।

৩রা সেপ্টেম্বর ছিল এ মহান শিল্পীর জন্মদিন। ৭১ পেরিয়ে ৭২-এ পা রাখলেন তিনি। এখনো গান করে চলছেন কিংবদন্তি এ শিল্পী। ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা এ গুণী শিল্পীর পৈতৃক নিবাস সাতক্ষীরায়। বাবা লুৎফর রহমান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, আর মায়ের নাম মৌলুদা খাতুন।

সাবিনা ইয়াসমিনদের পাঁচ বোনের মধ্যে চারজনই সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র—ফরিদা ইয়াসমিন, ফৌজিয়া ইয়াসমিন, নীলুফার ইয়াসমিন ও সাবিনা ইয়াসমিন। তাদের এ সংগীতপ্রেমী পরিবারের সঙ্গে আরো যুক্ত আছেন ভগ্নিপতি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সুরকার খান আতাউর রহমান এবং ভাগ্নে জনপ্রিয় শিল্পী আগুন। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তবে তার জীবনের মূল সুর বাঁধা ছিল গানের সঙ্গেই।

সুরের পথে পথচলা: মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথমবার মঞ্চে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন সাবিনা ইয়াসমিন। ১৯৬২ সালে রবীন ঘোষের সুরে ছোটদের জন্য গান গাওয়ার মাধ্যমে তার সংগীতজীবনের আনুষ্ঠানিক শুরু। একই বছর এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে গান করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ চলচ্চিত্রে তার প্লেব্যাক জীবনের শুরু। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের এক অপরিহার্য কণ্ঠস্বর।

তার দীর্ঘ সংগীতজীবনে পাঁচ হাজারের বেশি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন এবং সব মিলিয়ে তার গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। তার এ সফল যাত্রায় তিনি কাজ করেছেন সত্য সাহা, আলম খান, সুবল দাস, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আরডি বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়ী, আলী হোসেনের মতো অসংখ্য কিংবদন্তি সুরকারের সঙ্গে। একই সঙ্গে তার কণ্ঠ মিলেছে মান্না দে, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, কুমার শানু, শ্যামল মিত্রের মতো বিশ্ববরেণ্য শিল্পীদের সঙ্গে।

গানে গানে দেশপ্রেম ও স্বীকৃতি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সাবিনা ইয়াসমিনের নাম। গীতিকার নয়ীম গহরের লেখা এবং সুরকার আজাদ রহমানের সুরে তার গাওয়া কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। গানটি আজও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে দেশপ্রেমের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি।

সংগীতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাবিনা ইয়াসমিন ১৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, যা এক বিরল রেকর্ড। এছাড়া তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০২০ সালে প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্রে সর্বশেষ কণ্ঠ দেন এবং একই সঙ্গে সিনেমাটির চারটি গানে প্রথমবারের মতো সুরকার হিসেবেও কাজ করেন। ২০২৩ সালের শেষের দিকে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, মেলবোর্ন ও ব্রিসবেনে একাধিক স্টেজ শো করেছিলেন। এরপর সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার মঞ্চে গান করেন ।

এক বিশেষ ডকুফিল্ম: এ গুণী শিল্পীর জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি নির্মাণ হয়েছে বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র ‘জুঁই ফুল: সাবিনা ইয়াসমিন’। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ নির্মিত এ ডকুফিল্মে সাবিনা ইয়াসমিনের সংগীতজীবনের পথচলা, ব্যক্তিগত জীবনের অজানা অধ্যায় এবং স্মৃতিময় গল্পগুলো উঠে এসেছে। কালজয়ী গানের পরিবেশনা, আর্কাইভাল ভিডিও ও ছবি এবং সমসাময়িক শিল্পীদের অংশগ্রহণে এটি একটি বর্ণাঢ্য প্রামাণ্যচিত্র। এতে ১২ বছর বয়সে আলতাফ মাহমুদের হাত ধরে সিনেমায় গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়া থেকে শুরু করে দিলশাদ ইয়াসমীন থেকে ‘সাবিনা ইয়াসমিন’ হয়ে ওঠার দীর্ঘ ও সংগ্রামের গল্প ফুটে উঠেছে।