নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী

আমেরিকার শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫ | ০১:২৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ | ০১:২৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
আমেরিকার শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

যুদ্ধ অনেক ধরনের হয়। কখনও সরাসরি অস্ত্র দিয়ে হয়, কখনও ছায়া যুদ্ধ হয়, আবার কখনও অর্থ দিয়ে যুদ্ধ হয়। এবার আমেরিকা যা শুরু করেছে সেটা হলো বাণিজ্যিক যুদ্ধ।
যেহেতু এখনকার পৃথিবীতে কোনো দেশই একা চলতে পারে না, প্রত্যেকটা দেশ প্রত্যেকটা দেশের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত, তাই একটা দেশের বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত অন্য দেশকে প্রভাবিত করে। আর সেই দেশ যদি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ, তাহলে সেটা পুরো পৃথিবীকেই প্রভাবিত করে।

এখন কথা হলো, আমেরিকা কী করছে? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একদম সরল ব্যবসায়ীদের মতো হিসাব করছেন। যাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি আছে, অর্থাৎ যেসব দেশ আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে বেশি কিন্তু আমদানি করে কম, তাদের রপ্তানি পণ্যর ওপর অতিরিক্ত কর বসানো হবে। সহজভাবে, যারা আমারিকার কাছে বেশি পণ্য বিক্রি করে, কম কেনে তাদের বিক্রি করা পণ্যর ওপর কর বসানো হবে। এতে কী হবে? এতে আমেরিকা অতিরিক্ত অর্থ পাবে।

উদাহরণ দিই। মনে করি, বাংলাদেশ আমেরিকার কাছে ১০০ টাকার কাপড় বিক্রি করে কিন্তু ৬০ টাকার কম্পিউটার চিপ কেনে এবং এটিই একমাত্র বাণিজ্য দুই দেশের মধ্যে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ৪০ টাকা। মানে আমেরিকার ব্যয় তার আয়ের চেয়ে ৪০ টাকা বেশি। এখন আমেরিকা চিন্তা করল, তার আয় বাড়াবে। তাই সে বাংলাদেশের কাপড়ের ওপর ২০% কর বসিয়ে দিল। এখন বাংলাদেশের ১০০ টাকার কাপড় আমেরিকায় বিক্রি করতে হলে ২০ টাকা কর দিতে হবে। তাহলে আমেরিকার আয় হলো এখন ৬০ + ২০ = ৮০ টাকা। বাণিজ্য ঘাটতি ২০ টাকা কমে গেল।

এই অতিরিক্ত ২০ টাকা দেবে কে? বাংলাদেশ? উদাহরণ দিই। বাংলাদেশ কর বসানোর আগে কাপড় ৮০ টাকায় বানিয়ে ১০০ টাকায় আমেরিকায় বিক্রি করত। এখন বাংলাদেশকে একই কাপড় বিক্রি করতে ২০ টাকা দিতে হবে। তাহলে বাংলাদেশ কী করবে? বাংলাদেশ ৮০ টাকায় কাপড় বানাবে এবং সেই কাপড় ১২০ টাকাতে বিক্রি করে ২০ টাকা আমেরিকার সরকারকে দেবে আর বাকি ২০ টাকা সে মুনাফা করবে। তাহলে আমেরিকায় কাপড়ের দাম বেড়ে গেল, বাংলাদেশের মুনাফার শতাংশ একই থাকল। এই পুরো উদাহরণে ধরে নিই সব কিছু আগের মতো আছে, শুধু কর বসছে (স্যাটারস প্যারিবাস)। এই অতিরিক্ত ২০ টাকা বাংলাদেশ দিচ্ছে মনে হলেও আসলে দিচ্ছে আমেরিকার জনগণ। তবে শতাংশের হিসাবে আগের মতো মুনাফা থাকলেও মোট মুনাফা বাংলাদেশের কমে যাবে, কারণ বিক্রি হওয়া কপাড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা কমে যাবে।

তাহলে আমরা বুঝলাম, আমেরিকায় জিনিসের দাম বাড়বে বাংলাদেশের। আমেরিকার এমন বাণিজ্য ঘাটতি আছে ৪৮টি দেশের সঙ্গে (২০২৩ সালের হিসাবে)। সবচেয়ে বেশি চীনের সঙ্গে, ২৭৯ বিলিয়ন ডলার। এর পরে ১৫২ বিলিয়ন ডলার মেক্সিকোর সঙ্গে এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে ১০৪ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার (২৫তম স্থান)। এসব দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর আমেরিকা কর বসালে আমেরিকায় এসব দেশ থেকে আমদানি হওয়া সব পণ্যের দাম বাড়বে। আমেরিকা সরকারের আয় যেমন বাড়বে, সেই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিও বাড়বে।

আমেরিকা আয় বাড়ানোর জন্য চীনের ওপর অতিরিক্ত ২০%, কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫% কর বসিয়েছে। এসব দেশও আমেরিকার পণ্যর ওপর একই হারে কর বসিয়েছে, বা বসানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে চীনের বাজারে আমেরিকার পণ্যের দাম এবং আমেরিকার বাজারে চীনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে কম করে হলেও ২০%। কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমবে, বিনিয়োগ সক্ষমতা কমবে এবং বৈশ্বিকভাবে অর্থনীতি ধীরগতির হয়ে যাবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের রপ্তানিও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। যদিও ২৫তম স্থানে এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হওয়ার কারণে আমেরিকার সমহারে শুল্ক হয়তো বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। কিন্তু ট্রাম্পের আকস্মিক নীতি পরিবর্তনে যে কোনো কিছুর জন্যই বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে; বিশেষ করে ২০২৬-এ যখন আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করব।

বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০% আয় আসে আরএমজি থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আরএমজির বড় বাজার। যদি বাংলাদেশের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে মার্কিন ক্রেতাদের জন্য বাংলাদেশের কাপড়ের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আমাদের বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। শুধু তৈরি পোশাক নয়, ওষুধ, জুতা, চমড়া- যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখলের জল্য চেষ্টা করছে, তারাও এই সমস্যায় পড়বে। যেহেতু বাজারে স্থিতিশীলতার অভাব আছে , তাই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগও কমবে। এর ফলে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তাহলে আমেরিকার বর্তমান শুল্ক যুদ্ধে বাংলাদেশ কি শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হবে? উত্তর হলো- না। কারণ এটি আমাদের বাণিজ্যের নতুন সুযোগও তৈরি করবে। যেহেতু বিভিন্ন দেশ আমেরিকার পণ্যের ওপরও শুল্ক বসাচ্ছে, তাই সেসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশ করানোর ক্ষেত্রে আমরা কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ পাব। সেই লক্ষ্যে আমাদের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রচারণা এবং চেষ্টা চালাতে হবে। আবার আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি থেকে যেহেতু অনেক দেশের মুনাফা কমে যাবে, তাই সেসব পণ্য, বিশেষ করে কাঁচামালের গন্তব্য হতে পারে বাংলাদেশ, যা এখানে প্রসেস হয়ে চূড়ান্ত পণ্যরূপে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, এই শুল্ক যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন বাজার পর্যন্ত খুলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তা খুবই প্রয়োজনীয়।

চীন, কানাডা ও আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে এসব দেশে ব্যবসা করা কম্পানিগুলো অনিশ্চয়তায় পড়বে এবং অনেক উৎপাদন কলকারখানা অন্য দেশে সরিয়ে নিতে চাইবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এ দেশের সামনে একটা বড় সুযোগ থাকবে তাদের আকৃষ্ট করার- যদি বাংলাদেশ পারে তার কাঠামোগত ও ব্যবসায়িক কর্মক্ষমতার (ডুয়িং বিজনেস) উন্নয়ন করতে। যে কোনো যুদ্ধই দুঃখজনক হলেও কোনো না কোনো ব্যবসায়িক দরজা কারও না কারও জন্য খুলে দেয়। এই শুল্ক যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে চিন্তার ও সম্ভাবনার। আমাদের কূটনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দূরদৃষ্টিই পারবে এই যুদ্ধের দুশ্চিন্তা সরিয়ে আমাদের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করতে।

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি

শেয়ার করুন