১৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নিউইয়র্কে মামদানির জয়ে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির জয় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির জন্যই এক যুগান্তকারী ঘটনা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত, মুসলিম, তরুণ এবং ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ পরিচয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েও তিনি যেভাবে অ্যান্ড্রু কুমো ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করেছেন, তা আমেরিকান রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অর্থ ও প্রভাবনির্ভর রাজনীতির বিপরীতে নীতি, সততা ও জনকল্যাণের দর্শনকে সামনে রেখে তিনি জয়ী হয়েছেন—যা আজকের বিশ্বে এক বিরল ঘটনা।

মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হওয়া মামদানি অভিবাসীদের সন্তান, এবং সেই পরিচয় তিনি কখনো অস্বীকার করেননি। বরং বিজয় ভাষণে তিনি বলেছেন, “এই শহরের নেতৃত্ব এখন এমন একজনের হাতে, যে নিজেও অভিবাসীর সন্তান।” তাঁর বিজয়ে অংশ নিয়েছে এক লাখ তরুণ স্বেচ্ছাসেবক, যারা শহরের প্রতিটি মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের ভোটে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই সংগঠিত তরুণ প্রজন্মই মামদানির সবচেয়ে বড় শক্তি—যারা বিশ্বাস করে, রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতা নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

মামদানি যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, সেটিই তাঁকে জনমানুষের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, শহরে ঘর তৈরি করবে সরকার নিজে, যাতে সাধারণ মানুষের থাকার জায়গা হয়; শিশুযত্ন কেন্দ্র হবে বিনা মূল্যে; গণপরিবহন হবে সবার জন্য উন্মুক্ত; আর নিত্যপণ্য সাশ্রয়ী দামে পেতে সরকারি দোকান গড়ে তোলা হবে। এই নীতির মাধ্যমে তিনি শুধু অর্থনৈতিক সমতা নয়, এক নতুন সামাজিক চুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন—যেখানে শহর হবে নাগরিকদের, ডেভেলপার, ব্যাংকার বা বড় দাতাদের নয়।

নিউইয়র্কের নির্বাচনে ইসরায়েল প্রশ্নটি ছিল সবচেয়ে বড় নৈতিক বিভাজনরেখা। মামদানি বলেছেন, তিনি মেয়র হতে চান, বিদেশনীতি-দূত নয়, তাই ইসরায়েল সফরের কোনো পরিকল্পনা তাঁর নেই। এই কথাটি সাধারণের চোখে এক ধরনের সততা ও সাহসের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ইসরায়েলকে একটি স্থায়ী বৈষম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন এবং গাজার হত্যাযজ্ঞকে স্পষ্টভাবে ‘গণহত্যা’ বলেছেন। এর বিপরীতে কুমো প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, যদি নেতানিয়াহু বিচারাধীন হন, তবে তিনি তাঁকে রক্ষা করবেন। ভোটারদের চোখে নৈতিকভাবে দুর্বল ছিলেন কুমো, আর দৃঢ় ও মানবিক ছিলেন মামদানি।

তাঁর এই অবস্থান মার্কিন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছে। তারা কোনো মুখোশধারী উদারপন্থা নয়, সত্যিকারের ন্যায়বিচারের রাজনীতি দেখতে চায়। তারা বুঝে গেছে—গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট নয়, বরং অর্থনৈতিক সমতা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। এই চেতনা থেকেই তারা মামদানির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ফলে এই জয় শুধু একজন প্রার্থীর নয়, বরং এক প্রজন্মের আদর্শের জয়—যে প্রজন্ম বিশ্বাস করে, রাজনীতি মানে জনগণের সেবা।

এবার প্রশ্ন উঠছে, এই বিজয় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাঙালীদের জন্য কী বার্তা বহন করে। প্রথমত, মামদানির মতো প্রগতিশীল রাজনীতিকের উত্থান অভিবাসী সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়াবে। দীর্ঘদিন ধরে ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসীবিরোধী প্রচারণা এবং বর্ণবাদী রাজনীতির মধ্যে থাকা বাংলাদেশি অভিবাসীরা এখন নিজেদের রাজনৈতিক উপস্থিতি নতুনভাবে দেখতে পাবেন। নিউইয়র্কে বসবাসরত প্রায় ২ লক্ষাধিক বাংলাদেশি এখন এমন একজন মেয়রের নেতৃত্বে রয়েছেন, যিনি তাঁদের ধর্ম, জাতিগত পরিচয় বা অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে নয়, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে দেখেন।

দ্বিতীয়ত, মামদানির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে যে বিষয়গুলো রয়েছে—বিনামূল্যে শিশুযত্ন, সাশ্রয়ী বাড়িভাড়া, গণপরিবহন সহজলভ্যতা, এবং সরকারি মুদিদোকান—এসব উদ্যোগ নিউইয়র্কের বাংলাদেশি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অভিবাসীদের জীবনযাত্রায় সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অনেক পরিবার, যারা ঘরভাড়ার চাপে কিংবা সন্তান লালনপালনের খরচে সংকটে ছিলেন, তাঁরা এখন এই নতুন প্রশাসনের সুবিধা পাবেন।
তৃতীয়ত, মামদানির এই নীতি ও সাফল্য অভিবাসী তরুণ প্রজন্মকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া বা বড় হওয়া বাংলাদেশি তরুণদের জন্য এটি এক বড় অনুপ্রেরণা—যে তারাও মূলধারার রাজনীতিতে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে। মামদানির উত্থান প্রমাণ করেছে, বর্ণ, ধর্ম বা অভিবাসী পরিচয় কোনো বাধা নয়, বরং নীতিতে দৃঢ় থাকা আর জনগণের পাশে দাঁড়ানোই রাজনীতির আসল শক্তি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মামদানির এই জয়ের প্রতিফলন গভীর। এখানে রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ক্ষমতা, প্রভাবশালী পরিবার ও দলে দলে আনুগত্যের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। মামদানি দেখিয়ে দিয়েছেন, এসব না থাকলেও গণমানুষের আস্থা অর্জন সম্ভব—যদি রাজনীতি হয় সেবার, প্রতিশ্রুতির, ও নৈতিকতার। তাঁর জয় তাই মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতির পুনর্জাগরণ সম্ভব তখনই, যখন জনগণের প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবং রাজনীতিকরা মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় ও মামদানির উত্থান—এ দুটি ঘটনার মধ্যে এক গভীর প্রতীকী সম্পর্ক আছে। ট্রাম্প ছিলেন বিভাজনের রাজনীতির প্রতীক; মামদানি হয়েছেন ঐক্যের প্রতীক। ট্রাম্প মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, অভিবাসী পরিচয়ে ভাগ করেছেন; মামদানি বলছেন, “এই শহর সবার।” ট্রাম্প যেখানে ভয়ের রাজনীতি করেছেন, মামদানি সেখানেই আশা জাগিয়েছেন।

এই নির্বাচনের ফলাফল আমেরিকান গণতন্ত্রে এক বার্তা দিয়েছে—নৈতিকতা এখনো জিততে পারে, বিবেক এখনো পুঁজির চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে। আর বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি একটি শিক্ষা—যে স্বপ্ন বাস্তব হয় তখনই, যখন রাজনীতি আবার মানুষের হাতে ফিরে আসে। মামদানির উত্থান তাই কেবল নিউইয়র্কের গল্প নয়, এটি মানবতার, সমতার, এবং গণতন্ত্রের পুনরাবিষ্কারের গল্প।

মামদানির সামনে আগামী বছরগুলোতে সুযোগও রয়েছে অনেক কিন্তু কাজ করবার জন্য বাধাও কম নয়। যদি তিনি তাঁর ঘোষণাকৃত কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে সফল হন, তাহলে এটি শুধু নিউইয়র্ক নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক রূপান্তরেও পরিণত হতে পারে। অন্যদিকে যদি তিনি প্রশাসনিক বাস্তবতা ও দল-রাজনীতির চাপে আটকে পড়েন, তাহলে এই তরুণ-প্রজন্মের প্রত্যাশার সঙ্গে তার সাদৃশতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। যেকোনো ক্ষেত্রে, মামদানির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বর্তমান সময়ে নজরকাড়া এক পরীক্ষা-ভিত্তি পর্যায়ে রয়েছে।

মামদানির জয় প্রমাণ করেছে—রাজনীতি আবারও মানবিক হতে পারে, যদি নেতৃত্ব সাহসী হয় এবং জনগণের পাশে থাকে। আর নিউইয়র্কের মেয়রের চেয়ারে বসে এই তরুণ অভিবাসী নেতার প্রতিটি পদক্ষেপ এখন কেবল আমেরিকার নয়, বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের আশা হয়ে উঠেছে। তাঁর এই বিজয় বিশ্ব রাজনীতিতে এক নৈতিক জাগরণের সূচনা, যা হয়তো একদিন ঢাকাতেও প্রতিধ্বনিত হবে। রাজু আলীম: কবি ও সাংবাদিক। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে