যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের ‘আমব্রেলা সংগঠন’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সোসাইটির তার প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরপূর্তী অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপন করবে। ১৯৭৫ সালে সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘অগ্রযাত্রার ৫০ বছর’ শ্লোগানে আগামী ২ নভেম্বর, রোববার নিউইয়র্কের টেরেস অন দা পার্ক কনভেনশন হলে সোসাইটির ৫০ বছরপূর্তী উদযাপন করা হবে। বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জ্যাকসন হাইটসের নবান্ন পার্টি হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী একথা জানান।
সোসাইটির সভাপতি আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। যার মধ্য রয়েছে- সাবেক কর্মকর্তাদের সংবর্ধনা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা, বিশেষ আলোচনা সভা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রদর্শনী, প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিশেষ পরিবেশনা ও সম্মাননা প্রদান, প্রবাস ও কমিউনিটিতে অবদান রাখা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি। এছাড়াও স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিল, রক্তদান কর্মসূচি প্রভৃতিও থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ নেওয়াজ, সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম, সাবেক সভাপতি ডা. মোহাম্মদ হামিদুজ্জামান, ডা. ওয়াদুদ ভুইয়া, ডা. মিয়া, এম আজিজ ও আজমল হোসেন কুনু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন খান ও ফখরুল আলম শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও টাষ্ট্রি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে আজিমুর রহমান বুরহান, আজহারুল ইসলাম মিলন, হাওলাদার, ডা. এনামুল হক, আহসান হাবিব, কাজী সাখাওয়াত হোসেন আজম, মোহাম্মদ আতরাউল আলম ও নাঈম টুটুল এবং সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এরপর সিনিয়র সহ সভাপতি মহিউদ্দিন দেওয়ার শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। এরপর ২০০১ সালের ৯/১১ এর ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এবং দেশ-জাতির কল্যাণ কামনা করে বিশেষ দোয়া পরিচালনা করেন মওলানা মাসুম। এরপর এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। পরবর্তীতে লিখিত বক্তব্য রাখেন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ আলী জানান, সোসাইটির ৫০ বছরপূর্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের আনুমানিক বাজেট ধরা হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার ডলার। তবে সোসাইটির ফান্ড থেকে কোন অর্থ খরচ করা হবে না। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সোসাইটির এই অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মকে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে শাহ নেওয়াজ বলেন, সোসাইটির ভবন অর্থাৎ বাংলাদেশ কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য। এজন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আমরা ফান্ড রেইজ করে অর্থ সংগ্রহ করবো। আর সোসাইটি ভবনের নাম হবে বাংলাদেশ সোসাইটির নামে।
লিখিত বক্তব্যে মোহাম্মদ আলী বক্তব্যে বলেন, প্রায় ২৭ হাজার নিবন্ধিত সদস্যের সর্ববৃহৎ প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্ক। এ বছরের নভেম্বর মাসে গৌরবময় ৫০ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। অর্ধশতাব্দীর এই ঐতিহাসিক মাইলফলক উদযাপনকে কেন্দ্র করে আমরা হাতে নিয়েছি নানাবিধ কর্মসূচি ও উদ্যোগ, যা আজ আপনাদের সামনে প্রাথমিকভাবে তুলে ধরতে এবং আপনাদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কমিউনিটি এবং সকল সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাতে আজকের এই আয়োজন।
আজ বিশেষ দিন ১১ সেপ্টেম্বর। এই দিনটি আমাদের সবার জন্য গভীর বেদনার, কারণ ২০০১ সালের এই দিনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় হাজারো নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন আমাদেরই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ভাই-বোন। সোসাইটি ইন্ক-এর পক্ষ থেকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ৯/১১-এ সকল নিহতদের। প্রার্থনা করছি তাঁদের আত্মার শান্তির জন্য এবং তাঁদের পরিবার যেন ধৈর্য ও শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে পাওে এবং সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
মোহাম্মদ আলী বলেন, বাংলাদেশ সোসাইটি কেবল একটি সংগঠন নয় এটি প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঐক্যের প্রতীক, পরিবারের বন্ধন, এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয়ের ভিত্তি। ১৯৭৫ সালে যাত্রা শুরু করা এই সংগঠন আজ অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একটি স্বনির্ভর, প্রভাবশালী ও সেবামুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা কৃতজ্ঞ তাঁদের প্রতি যাঁরা এই সংগঠনকে গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ সোসাইটির এই সাফল্যময় অর্ধশতাব্দীতে প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা বিশাল একটি স্বপ্নের বীজ বপন করে গেছেন। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যবৃন্দ নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে। আজ বাংলাদেশ সোসাইটি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বনির্ভর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই দীর্ঘ যাত্রায় প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের সকল নেতৃবৃন্দ, সদস্য, শুভানুধ্যায়ী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের শ্রম, ত্যাগ, দিকনির্দেশনা এবং অবদানের প্রতি আমরা গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই। একইসঙ্গে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই তাঁদের প্রতি, যাঁরা আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁদের ত্যাগ, ভালোবাসা ও নিবেদিত সেবা আজও বাংলাদেশ সোসাইটিকে শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
মোহাম্মদ আলী তার লিখিত বক্তব্যে আরো বলেন, করোনা মহামারি থেকে শুরু করে যে কোন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রতিটি সদস্যের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি প্রমাণ করেছে সদিচ্ছা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব। এর মাধ্যমে প্রবাসে থাকা সদস্যদের কল্যাণ ছাড়াও বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বার বার অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ সোসাইটি। এই সংগঠন বিভিন্নভাবে প্রবাসীদের সেবা দিয়ে আসছে। প্রবাসীরাও এসব সেবায় উপকৃত হচ্ছেন। ভ্রাম্যমান কনস্যুলেট সার্ভিস, ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত তথ্যসেবা, প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাংলা শিক্ষার জন্য বাংলা স্কুল স্থাপন যা কুইন্স এবং ব্রুকলীনে নিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে এছাড়াও দৈনন্দিন নানান প্রয়োজনে বাংলাদেশ সোসাইটি পাশে দাঁড়িয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের। নিজস্ব কবরস্থানের মাধ্যমে সোসাইটি তার একটি বড় সামাজিক দায়িত্বে নিজেকে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ৫০ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রা কেবল উৎসবের নয়, এটি আবেগ, দায়িত্ব ও স্মৃতিরও যাত্রা। তাই মূল অনুষ্ঠানের আগে আমরা আয়োজন করব কয়েকটি ছোট কিন্তু অর্থবহ কর্মসূচি। তার মধ্যে রয়েছে-স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিল, রক্তদান কর্মসূচি, কমিউনিটি আলোচনা সভা প্রভৃতি।
মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি আগামী ২ নভেম্বর নিউইয়র্কের বিখ্যাত কনভেনশন হল টেরেস অন দা পার্কে, অনুষ্ঠিত হবে সুবর্ণজয়ন্তীর মহা-উদযাপন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে এই অনন্য আয়োজন, যেখানে মিলিত হবে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবেগ, কৃতজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাথমিক কর্মসূচির মধ্যে থাকবে- সাবেক কর্মকর্তাদের সংবর্ধনা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রধান, বিশেষ আলোচনা সভা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রদর্শনী, প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিশেষ পরিবেশনা ও সম্মাননা প্রদান, প্রবাস ও কমিউনিটিতে অবদান রাখা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মোহাম্মদ আলী বলেন, সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অন্যতম প্রধান উদ্যোগ হলো একটি স্মারকগ্রন্থ (স্মরণিকা) প্রকাশনা। এটি কেবল একটি বই হবে না; বরং হবে আমাদের অর্ধশতাব্দীর যাত্রাপথের একটি জীবন্ত দলিল। এতে লিপিবদ্ধ হবে বাংলাদেশ সোসাইটির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস, অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম, সাফল্য, এবং প্রবাসীদের গল্প। স্মরণিকায় যারা লেখা দিতে আগ্রহী তারা অবশ্যই আগামী ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সোসাইটির ইমেইলে মূল্যবান লেখাটি পাঠাতে অনুরোধ জানান।
লিখিত বক্তব্যে মোহাম্মদ আলী আরো বলেন, সুবর্ণজয়ন্তী শুধু অতীত উদযাপন নয়, এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। বর্তমান কার্যকরী পরিষদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে আমরা বাংলাদেশ কমিউনিটি সেন্টার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এটি বাস্তবায়িত হলে প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জন্য এটি হবে একটি স্থায়ী ঠিকানা যেখানে তারা একত্রিত হবে, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, এবং বাংলাদেশি পরিচয়ের শেকড়কে আরও দৃঢ় করবে। সুবর্ণজয়ন্তীর মহা-উদযাপন এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
উল্লেখ্য, সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সোসাইটির নতুন ভবন কার বা কোন নামে হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সাবেক সভাপতি ডা. ওয়াদুদ ভুইয়ার পাল্টা প্রশ্নে (সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করতে পারেন কি না? এটা কেমন সাংবাদিকতা?) উপস্থিত সাংবাদিকরা তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান। সেই সাথে সংবাদ সম্মেলন স্থলে বাক-বিতন্ডা আর চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ট্রাষ্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান জনাব শাহ নেওয়াজ সোসাটাইর ভবন সোসাইটির নামেই হবে ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং সোসাইটির সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম সাংবাদিকদের কাছে দু:খ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রর্থনা করে সোসাইটির কর্মকান্ডে সবার সহযোগিতা কামনা করেন। খবর ইউএনএ’র, সকল ছবি পরিচয় এর নিজস্ব।