গত ২৩ সেপ্টেম্বর ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে খোদ জাতিসংঘেরই প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বজুড়ে সংঘাত রোধে নিজের সাতটি মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা সফল হয়েছে দাবি করে তিনি বিশ্ব সংস্থাটিকে অভিযুক্ত করেছেন, এসব সংঘাত রোধে জাতিসংঘ সাহায্যের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। জাতিসংঘের ‘বিশাল সম্ভাবনা’ থাকার কথা স্বীকার করেও তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত সংস্থাটি সেই সম্ভাবনার কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনে সংস্থাটির সক্ষমতা ও সফলতা নিয়ে অতীতেও বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠেছে। বিশেষত প্রায় আট দশক ধরে ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন ইস্যুতে জাতিসংঘের ‘এক পা এগিয়ে দুই পা পেছানো’ সত্যিই সমালোচনাযোগ্য। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভেটো ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের মুখ থেকে সরাসরি এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হলো।
জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনও নতুন নয়। শীতল যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব সংস্থাটিকে করায়ত্তের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। মনে আছে, ১৯৯১ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব হন মিসরীয় কূটনীতিক বুট্রোস বুট্রোস ঘালি। সোমালিয়া, রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার মতো অঞ্চলে যুদ্ধ ও সংঘাত নিয়ন্ত্রণে তখন হিমশিম খাচ্ছে জাতিসংঘ। এমনি অবস্থায় ঘালির মনে হয়েছিল, সংস্থাটির বিশাল ব্যয়ের তুলনায় অর্জন নগণ্য। সে কারণে ১৯৯২-৯৩ সালে সংস্থাটিকে ‘শ্বেতহস্তী’ আখ্যা দিয়ে তিনি একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জাতিসংঘের কার্যকারিতা বাড়াতে তিনি এর আমলাতান্ত্রিক পরিধি সংকোচন ও কর্মকাণ্ড বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেন। ঘালির এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপিয়ে তোলে; পরিণতিতে রেওয়াজ মেনে তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে আর মহাসচিব করা হয়নি। জাতিসংঘের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত একমাত্র ঘালিই দ্বিতীয় মেয়াদে মহাসচিব হতে পারেননি।
যুক্তরাষ্ট্র সবসময় পছন্দের ব্যক্তিকে জাতিসংঘ মহাসচিব পদে বসাতে চায়। এ ক্ষেত্রে ঘালি দেশটির পছন্দের তালিকার বাইরে থাকলেও তখনকার বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে প্রথম মেয়াদের জন্য মেনে নিয়েছিল। ঘালি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি প্রস্তাব দেয়, যার সারকথা– ওয়াশিংটনের প্রেস্ক্রিপশন মতো জাতিসংঘ প্রস্তাব উত্থাপন করবে আর যুক্তরাষ্ট্র তা বাস্তবায়ন করবে। ঘালি মনে করেছিলেন, শান্তির স্বার্থে সম্পূর্ণ দায়িত্ব জাতিসংঘেরই নেওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে তিনি বিশ্বশান্তি রক্ষায় ‘প্রতিরোধমূলক কূটনীতি’ এবং ‘দ্রুত মোতায়েনযোগ্য ইউনিট’ স্থাপনের পরামর্শসহ দুটি মূল দলিল উপস্থাপন করেন। ওয়াশিংটন এতে ক্ষুব্ধ হয় এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের দ্বিতীয় মেয়াদের আলোচনা চলাকালে তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট ঘালিকে ‘অবিশ্বস্ত ও নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে ১৯৯৫ সালের ২৫ জুন এক বিবৃতি দেন। ঘালিকে বিদায় নিতে হয় এবং সেই পরিণতি দেখেই উত্তরসূরিদের কেউ যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটাতে সাহস করেননি।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘকে বাগে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় এর বাজেট সীমাবদ্ধতার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে (২০২৪-২৫) জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাজেট ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর প্রায় ২৩ শতাংশ বহন করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নিয়মিত পরিশোধ না করায় অনেক বছরের অর্থ বকেয়া রয়েছে বলে শোনা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বকেয়া পরিশোধ তো বন্ধ রেখেছেনই; ২০২৪ সালের প্রাপ্য অর্থও ছাড় করেননি। এক তথ্যমতে, সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শান্তিরক্ষা তহবিলসহ ৩শ কোটি ডলার পাওনা জাতিসংঘের।
এই বাস্তবতায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনে জাতিসংঘ বিশেষত শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে নিশানা করেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বিতর্কের অনেক অবকাশও রয়েছে। আমি নিজে জাতিসংঘের ৫টি মিশনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কয়েকটি বিশেষ দেশের দূতাবাসের সঙ্গে ‘পরামর্শ’ করে। প্রকৃতপক্ষে সেই পরামর্শের বাইরে যাওয়ার তেমন সুযোগ জাতিসংঘের থাকে না। যে কারণে জাতিসংঘ মিশনকে অনেকে ‘পি ফাইভ ক্লাব’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। তাই বলে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ার কথা বলার সুযোগ নেই।
গত শতকের মাঝামাঝি জাতিসংঘ যখন যাত্রা করে, এর প্রধান লক্ষ্যই ছিল বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করা। কালক্রমে এর পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে; জড়িয়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এখন এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে ইউএনডিপি, ইউনিসেফের মতো জাতিসংঘের কোনো না কোনো উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে না। যে কারণে জাতিসংঘের প্রয়োজন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে বৈ কমেনি। তবে শান্তিরক্ষী মিশনগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই রয়েছে। এগুলো কীভাবে আরও কার্যকর হতে পারে, তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের ‘চ্যাপ্টার ৭’ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত মিশনগুলোতে জাতিসংঘ অনেকখানি সফল হয়েছে। যেমন কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘ পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু অধিকাংশ দেশেই, যেখানে জাতিসংঘ ‘সহায়তাকারী’ হিসেবে কাজ করেছে বা করছে, সেখানে এর সফলতা উল্লেখযোগ্য নয়। অনেক সময় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়ার কারণেও সেসব দেশে জাতিসংঘ স্বাধীন সত্তা নিয়ে কাজ করতে পারে না।
এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। জাতিসংঘ যখনই নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, তখনই শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কোপানলে পড়েছে। বুট্রোস ঘালি বসনিয়ান সংঘাতকে ‘ধনীদের যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে সার্বিয়ান অবস্থানগুলোতে বোমা হামলা চালাতে ন্যাটোর বিমান শক্তি ব্যবহারের মার্কিন পরিকল্পনায় সবুজ সংকেত দিতে দ্বিধা করায় যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ লেবাননে জাতিসংঘ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শতাধিক বেসামরিক নাগরিক হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের জড়িত থাকার জাতিসংঘের তদন্তের ফলাফল প্রকাশেও ঘালি জোর দিয়েছিলেন। ফলে ওয়াশিংটনের ক্ষোভ আরও চরমে উঠেছিল।
সাম্প্রতিককালেও জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো অবস্থান নিলে ‘দেখে নেওয়া হবে’ বলে হুমকি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বেশির ভাগ সদস্য রাষ্ট্র ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এর পরপরই জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ঘোষণা দেন, পরবর্তী অর্থবছরে জাতিসংঘে অর্থায়ন ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার কমাবে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ২০২৫ সালে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যা-ই বলুন না কেন, মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই– জাতিসংঘের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বরং বিদ্যমান বৈশ্বিক অবস্থায় এর প্রয়োজন আরও বেড়েছে। তবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রয়োজন সংস্থাটির কাঠামোগত সংস্কার। চার দশক আগে এর ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন বুট্রোস বুট্রোস ঘালি। মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে