২৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জুলাই সনদ কি টেকসই হবে

বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদে এ পর্যন্ত সই দিয়েছে ২৫টি রাজনৈতিক দল। সনদে উল্লেখিত প্রস্তাবগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আছে। সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষ আদেশের খসড়া তৈরি করেছে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। হয়তো আজকালের মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে কমিটির সুপারিশ জমা দেবে ঐকমত্য কমিশন।

সনদের খসড়া তৈরির কাজ যখন চলছিল, কীভাবে এর বাস্তবায়ন হবে, তখন এটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের আওতায় ছিল না। তখনই এ নিয়ে কথাবার্তা হতে থাকে। প্রশ্ন উঠেছিল, এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলে এটি কেবল কাগুজে দলিল হয়েই থাকবে।

৩১ জুলাইয়ের পর ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। ৯ অক্টোবর এ আলোচনা শেষ হয়। আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়।

যতটুকু জানা গেছে, সনদ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে একটি বিশেষ আদেশ জারি করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে ওই আদেশের ওপর অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। ভবিষ্যতে যে সংসদ হবে, তার দ্বৈত ভূমিকা থাকবে। একটি ভূমিকা হলো সংবিধানের দরকারি সংশোধনগুলো করা। অন্যটি হলো নিয়মিত সংসদ হিসেবে পরবর্তী নির্বাচনের আগপর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া।

জানা গেছে, প্রাথমিক খসড়া অনুযায়ী এ আদেশের নাম হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’। এটি সংবিধান ও অন্যান্য আইনের পরিপূরক হবে। এ আদেশের ভিত্তি হবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। অর্থাৎ ‘গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আদেশ জারি করা হবে’। আদেশের পরিশিষ্টে থাকবে জুলাই জাতীয় সনদ। এ আদেশের ওপর হবে গণভোট। যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটাও এখানে উল্লেখ থাকতে পারে (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০২৫)।

এ আদেশ জারি নিয়েও আছে মতভেদ। বিএনপি একটি বড় দল। দলটি এ ধরনের বিশেষ আদেশ জারি সমর্থন করে না। আবার কয়েকটি দল, যেমন জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি, এ রকম একটি আদেশ জারির দাবি জানিয়ে আসছে।

আদেশ জারি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু না বলায় এনসিপি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছিল। শুধু বর্জন নয়, তারা একটি সমাবেশ ঘটিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধা দিয়েছিল। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সমবেত ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে। জনমনে ধারণা, এনসিপি এটি ঘটিয়েছে, যদিও দলটির শীর্ষ নেতাদের কেউ ওই সমাবেশে ছিলেন না। ফলে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন হয়েছে। এত সময় ও শ্রম দিয়ে এ আয়োজনের ব্যবস্থা হলেও তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।

জুলাই সনদে বর্ণিত অঙ্গীকারনামা শেষ মুহূর্তে এসে পরিমার্জন করা হয়েছে, যেটি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়। ঐকমত্য কমিশন এ বিষয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে বলেই শেষ মুহূর্তে এসে কিছু অঙ্গীকারের কথা সংযোজন করেছে। প্রশ্ন হলো, কমিশন এটি আগে কেন বিবেচনায় নেয়নি? এ নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, এটুকু বোঝার মতো কেউ কি কমিশনে ছিলেন না? নাকি কোনো বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে প্রবোধ দিতে তাঁরা শেষ সময়ে এসে দু-চার কথা লিখেছেন? তার মানে কি এই যে কমিশন স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করতে পারে না? চাপ দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়?

আবার আসি মূল সনদ বিষয়ে। দেখা গেছে, ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে গুটিকয় ছাড়া সব কটিতে ঐকমত্য হয়নি। এক বা একাধিক দল প্রস্তাবের কোনো কোনো অংশে আপত্তি জানিয়েছে। একটা উদাহরণ দিই। বিচার বিভাগসংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘আইনজীবীদের আচরণবিধি যুগোপযোগীকরণ, জেলা পর্যায়ে বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এবং এর প্রধান হিসেবে একজন বিচারককে দায়িত্ব প্রদান করা হবে। অপর দিকে আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হবে।’ চারটি দল এ প্রস্তাবের শেষ বাক্যে আপত্তি জানিয়েছে। তার মানে তারা চায় আইনজীবীরা আদালতে দলবাজি অব্যাহত রাখুন।

আরেকটি প্রস্তাবে আছে, ‘ভৌগোলিক ও যাতায়াত বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠন করা হবে।’ একটি দল ছাড়া সবাই এ প্রস্তাবে একমত। এখানে প্রশ্ন হলো, প্রশাসনিক বিভাগ করার মতো একটি প্রস্তাব জুলাই সনদে উত্থাপিত হলো কীভাবে? ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগের সংখ্যা কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এটি অভ্যুত্থান–পরবর্তী সনদে স্থান পাবে? বিভাগ হচ্ছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বাইরে অন্তঃসারশূন্য একটি স্তর, যার কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক উপযোগিতা নেই। অপ্রয়োজনীয় কিছু সরকারি পদ তৈরি করে জনগণের ওপর খরচের বোঝা বাড়ানো ছাড়া প্রশাসনিক বিভাগের আর কী গুরুত্ব আছে? তা ছাড়া এ দেশে জেলা জাতীয়তাবাদ এত প্রবল যে বিভাগ বানিয়ে সবাইকে খুশি করা যাবে না। প্রায় প্রত্যেক জেলাই বিভাগ হতে চায়।

যেখানে এক বা একাধিক দল আপত্তি দিয়েছে, সেখানে বলে হয়েছে, ‘অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’ তার মানে, এই সনদের বাস্তবায়ন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বাধ্যতামূলক নয়। আমরা জানি, যে পদ্ধতিতে যে ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করা যায়, সনদের বাস্তবায়নও হবে সেভাবে। এখানে সংসদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে। নির্বাচিত সংসদই দেবে আইনি ভিত্তি। নির্বাচনের আগে যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার চলে, নির্বাচিত সংসদ দরকার মনে করলে সেটি বাতিল করে দিতে পারবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের স্ববিরোধী আচরণ লক্ষ করা যায়। তারা অনেক দাবিদাওয়া নিয়ে মাঠে আছে। কেউ কেউ চায় নির্বাচনের আগেই অন্তর্বর্তী সরকার এসব মেনে নিক, সংস্কার করুক। আবার তারাই বলছে নির্বাচিত সরকার সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে—কোনটা রাখবে আর কোনটা ফেলে দেবে। তাহলে এই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে এত হইচই কেন?

এবার আসা যাক গণভোট প্রশ্নে। এর আগেও এ দেশে কয়েকবার গণভোট হয়েছে। সেখানে সরাসরি একটাই প্রশ্ন ছিল—আপনি এতে সম্মতি দিচ্ছেন কি না। ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’। এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ। জুলাই সনদে আছে ৮৪টি প্রস্তাব। এগুলোর মধ্যে আছে অনেক উপপ্রস্তাব। একজন নাগরিক যদি কয়েকটি প্রস্তাব সমর্থন করেন আর কয়েকটি বিষয়ে তাঁর আপত্তি থাকে, তিনি গণভোটে রায় দেবেন কীভাবে?

জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী? কেউ কেউ বলছেন, এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। তাতে কি এটা চিরস্থায়ী হবে? যখন যে দল সংসদে রাজত্ব করবে, তারা তো তাদের ইচ্ছামাফিক সংবিধান থেকে অনেক কিছু বাদ দিতে পারে, আবার অনেক কিছু ঢোকাতেও পারে। যেমন বাহাত্তরের সংবিধানে অনেক কিছু ছিল না। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ৭ মার্চের ভাষণ আর ১৭ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে ঢুকিয়েছে।

জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ হলেও এটি যে টেকসই হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে এখনো মাতম হয়। বাহাত্তরের সংবিধান যে সংবিধানপ্রণেতারাই বাহাত্তরে রাখেননি, দুই বছরের মধ্যে এর খোলনলচে যে অনেক পাল্টে দিয়েছেন, এটা তো আমরা দেখেছি। ভবিষ্যতেও এমন হতে থাকবে।

ঘড়ির কাঁটা এক জায়গায় স্থির থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজন আর আকাঙ্ক্ষা ওঠানামা করে। তখন অনেক কিছুই বদলে যায়। বদলাতে হয়। মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে