১৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অবৈধ অভিবাসন ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি

চলতি সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ইতালি সম্পর্কবিষয়ক এক সেমিনারে ইতালির রাষ্ট্রদূত অ্যান্টোনিও আলেসান্দ্রো বলেছেন, ‘অভিবাসন অবশ্যই আইনসিদ্ধ পথে হতে হবে’ (বাসস, ১০ নভেম্বর ২০২৫)। তিনি জানান, চলতি বছরে প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করেছেন; অন্যদিকে মাত্র ৯ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বৈধ ভিসা পেয়েছেন, যাদের মধ্যে ৫৩০ জন শিক্ষার্থী। তাঁর সতর্কবার্তা ছিল আরও স্পষ্ট: অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মিথ্যা আশ্রয় প্রার্থনা বাংলাদেশের পাসপোর্টের বৈশ্বিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে জটিল করে তুলছে।

রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্য কেবল পরিসংখ্যান হিসেবে দেখা যাবে না; বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বার্তা। বাংলাদেশের জন্য অভিবাসন একদিকে অর্থনৈতিক শক্তির উৎস, অন্যদিকে ভাবমূর্তি রক্ষারও বিষয়। শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছরের লুটপাটে বিধ্বস্ত অর্থনীতির দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে কোটি প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে। কিন্তু এর মধ্যেই ক্ষুদ্র এক দল বাংলাদেশি মিথ্যা তথ্য, জাল নথি তৈরি ও অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাদের কারণে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী সবার বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ।

বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার ইতিহাস নতুন নয়। তবে এত ব্যাপকভাবে অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা আগে ছিল না। আমার পরিচিত একজন ১৯৮২ সালে প্রথমবার বিদেশ গিয়েছেন; কানাডায় অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে পড়তে। একবার গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, ২০১০ সালের পর কানাডার ভিসা নিতে তাঁকে এমন সব কাগজপত্র দিতে হয়েছিল, যা কল্পনাতেও ছিল না।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে বাংলাদেশিদের মধ্যে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার বুদ্ধি শুরু হয়, যা পরের প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আগের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায় প্রয়োগ হয়েছে। ২০১৩ সালের পর রাজনৈতিক নিপীড়নের পাশাপাশি ‘জঙ্গি হামলার ঝুঁকিতে’ থাকার অজুহাতও যুক্ত হয়েছে। বাস্তবে যত বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে, তার সব না হলেও বেশির ভাগই মনগড়া। কার্যত জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ-নির্ভরতা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর অ্যাসাইলাম বলছে, ২০২৪ সালে ইউরোপে প্রায় ৪৩ হাজার বাংলাদেশি আশ্রয় চেয়েছে, যার ৯৬ শতাংশের আবেদন প্রত্যাখ্যাত। এত বিপুলসংখ্যক মিথ্যা আবেদন প্রকৃত ভিসাপ্রার্থীর সুযোগও সংকীর্ণ ও কঠিন করে তুলেছে। প্রবাসী ও অভিবাসী সংগঠনের মত অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা ইউরোপে পৌঁছাতে চান, তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ধরা পড়েন বা মারা যান। বাকি দুই-তৃতীয়াংশই কোনোভাবে গন্তব্যে পৌঁছান। তবে যারা ব্যর্থ হন তাদের কাহিনি তত বেশি প্রকাশ পায় না। যারা সফল হয়ে বাড়িতে রেমিট্যান্স পাঠান, গ্রামের লোকজন তাদের কথা শুনে উৎসাহিত হয়। তাকে অনুকরণ করতে চায়। এভাবেই ‘সফলতার’ বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত গড়ে ওঠে।

অন্যদিকে যারা বৈধভাবে বিদেশে যান, তাদের মধ্যেও অনেকে স্থানীয় আইন মানার ক্ষেত্রে অমনোযোগী। কেউ আবার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও থেকে যান; কেউ অবৈধভাবে কাজ করেন, কেউ অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এসব আচরণ শুধু ব্যক্তিগত লজ্জার নয়; প্রবাসী বাংলাদেশি ও দেশের জন্য অবমাননাকর। ইতালির রাষ্ট্রদূতের কথা গভীর চিন্তার বিষয়: অবৈধ অভিবাসন বাংলাদেশের পাসপোর্টের মান কমিয়ে দিচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ওপরেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এ অবস্থায় ইতালির সঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড মোবিলিটি’ সমঝোতা স্মারক একটি ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বৈধ পথে অভিবাসন বাড়ানো, সিজনাল ও নন-সিজনাল কর্মী নিয়োগ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ভাষা শেখানো এবং কোটা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরির আশা করা হচ্ছে।

তবে কেবল চুক্তি স্বাক্ষর করলেই সমস্যা মিটবে না, আরও অনেক কিছু করতে হবে। প্রথমত, গ্রামে গ্রামে সচেতনতা ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম নিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, জমিজমা বিক্রি করে সন্তানকে সাগরপথে পাঠানো মানে ঝুঁকি ও ধ্বংস। দ্বিতীয়ত, রিক্রুটার ও দালাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর অভিযান চালাতে হবে। তৃতীয়ত, দেশে দক্ষতা উন্নয়ন ও বাস্তব কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। কারণ দক্ষতা ছাড়া বৈধ চ্যানেলগুলোতেও প্রবেশ কঠিন। এ জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সংযোগ আবশ্যক। চতুর্থত, বাংলাদেশি মিশনগুলোর মাধ্যমে নতুন অভিবাসীদের জন্য আইন ও আচরণগত ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় জব মার্কেট ও শ্রম অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার।

বিদেশে যাওয়া অপরাধ নয়, বরং আমাদের দেশের আকার ও জনসংখ্যা বিবেচনায় আরও অন্তত এক কোটি তরুণকে বিদেশে পাঠানো হতে পারে বেকারত্ব দূর ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় ক্ষেত্র। কিন্তু বিদেশে গিয়ে নিজের দেশকে ছোট করা যে নৈতিক অপরাধ– এ কথা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিশুদের শেখাতে হবে। প্রবাসীরা বাংলাদেশের অঘোষিত দূত– আমাদেরকে বুঝতে হবে।

বস্তুত ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, আচরণ দিয়েই বিশ্ববাসী আমাদের দেশকে চেনে। যে দেশের নাগরিক সত্যবাদী, দায়িত্বশীল ও আইন মান্য করে, সেই দেশের সম্মান তৈরি হয় বিদেশের মাটিতে। এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এই দায়িত্ববোধ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। বিদেশে গিয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মর্যাদাও টিকিয়ে রাখা প্রকৃত দেশপ্রেম। মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন।