শীলা ভাট: বিশ্ব এখন ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে। ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশের অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন শুল্ক আরোপ করার যে সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়েছেন, তা ভারতের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে। এ চাপ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভারতীয় কূটনীতির নতুন পথ খুঁজে নিতে বাধ্য করছে। মোদির দল আশা করছে, মোদির বেছে নেওয়া নতুন পথ ভারতের ঘরোয়া রাজনীতিকে আরও সংহত করবে।
সাত মাস ধরে ট্রাম্পের কূটনীতির লক্ষ্য হচ্ছে তার মূল ভোটার গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখা, বিশাল মার্কিন ঋণ কমানো এবং তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (সংক্ষেপে যাকে বলে ‘মাগা’) পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। ট্রাম্পের এই মাগা রাজনীতি সারা বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
এটা একধরনের বিদ্রূপ যে মোদির সমর্থকদের বড় অংশই ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আরও মজবুত করার পক্ষেই ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এ ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ তাদের মনে অবিশ্বাসের বীজ বপন করবে।
১৯৭১-৭২ সালের ইন্দিরা গান্ধীর পর ভারতীয় কোনো নেতা খুব কমই এমন সংকটময় অবস্থায় পড়েছেন, যেখানে ‘শয়তান’ আর ‘অতলপাতাল’—এই দুটোর একটাকে বেছে নিতে হয়, অর্থাৎ এদিকেও বিপদ, ওদিকেও বিপদ। তবে মোদি এখন তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
দীর্ঘ আলোচনার পর মোদি ট্রাম্পের ভারতবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে ‘দাঁড়িয়ে যাওয়ার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিজেপির নেতারা ইতিমধ্যেই বলছেন, ভারতকে ট্রাম্পের নির্দেশ না মানার কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
মোদিই স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তাঁর নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রতের কৃষক, জেলে ও পশুপালনকারী সম্প্রদায়ের স্বার্থের ক্ষতি করে, এমন যেকোনো নীতির বিরুদ্ধে মোদি দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে মস্কোয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে জয়শঙ্কর ট্রাম্পের সঙ্গে ইংরেজিতে সাবলীল কথা বলতে পারেন এবং পুতিনের সঙ্গে রুশ ভাষায় জারদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। সব মিলিয়ে ভারত-রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এখন এক নতুন গুণগত পর্যায়ে প্রবেশ করছে।
মোদির চীন সফর প্রমাণ করছে, শুল্কবৃদ্ধির আঘাত থেকে দুর্বল ভারতীয় অর্থনীতিকে সামলাতে ভারত কতটা প্রস্তুত। সংকটে পড়লে মোদি নমনীয় কৌশল অবলম্বন করেন। এক ঘনিষ্ঠ সূত্রের ভাষায়, ‘টিম মোদি’ এখন বাণিজ্য ও শুল্কসংক্রান্ত বিষয়গুলো সামাল দিচ্ছে চারজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সমন্বয়ে।
বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলকে ওয়াশিংটনে বাণিজ্যচুক্তি ও শুল্কসংক্রান্ত আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের অন্য সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, কৃষি ও কৃষককল্যাণমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এবং অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। তাঁরা নিয়মিত বৈঠক করছেন এবং বাস্তব সময়ে মতামত ও তথ্য বিনিময় করছেন।
শুল্কযুদ্ধের কারণে নরেন্দ্র মোদি এখন নয়াদিল্লির প্রো-আমেরিকান ও অ্যান্টিচায়না (চীনবিরোধী) লবির আক্রমণের মুখে। অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক, যাঁরা মোদি সরকারের রাজনীতির সমালোচক ছিলেন, তাঁরা রাতারাতি চীনের সঙ্গে সংলাপ পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি হজম করতে পারছেন না। বিশেষত অভিযোগ রয়েছে যে পাকিস্তানকে সহায়তায় চীন ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভূমিকা রেখেছিল।
তাঁরা জোর দিয়ে বলছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বর্তমান জটিল অবস্থার জন্য মূলত ‘মোদির কূটনীতিই বেশি দায়ী’। তাঁদের ধারণা, চীনের প্রতি ভারতের এ নরম অবস্থান কোনো মূল্য ছাড়া আসবে না।
অন্যদিকে পাকিস্তানকে ‘খেলায় ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করা এবং রুশ তেল আমদানির বিষয়ে নয়াদিল্লির প্রতি ট্রাম্পের অবস্থান ভারতের সব রাজনৈতিক মহলের কাছে ‘অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর’।
মোদির সমালোচকদের মতে, ভারত এখন কৌশলগত প্রজ্ঞার চেয়ে বাধ্যবাধকতা থেকেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। না হলে রাতারাতি কোয়াড উদ্যোগকে স্থবির করে দিয়ে ব্রিকসকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাখ্যা কী হতে পারে? তবে চাকরির বাজার ও জিডিপিতেও প্রভাব ফেলতে পারে, এমন গভীরতর সংকটের মুখে এ সমালোচনা এখন অনেকটাই অর্থহীন হয়ে গেছে। মোদি সম্ভবত এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দেবেন না। কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনের তারিখও এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
আরও তীব্র সমালোচনা আসছে তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা সারা জীবন ভারত-মার্কিন সম্পর্ক দৃঢ় করতে কাজ করেছেন। তাঁরা অভিযোগ করছেন, মোদি ও জয়শঙ্করের যুগলবন্দী ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের এজেন্ডা সঠিকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে মোদি-জয়শঙ্কর জুটি এসব সমালোচনা পাত্তা দিচ্ছেন না। কারণ, মোদির হাতে সময় নেই। বৈশ্বিক বাজারে এখন ভারতের জন্য উপযুক্ত বিকল্পও বেশি নেই। এ মুহূর্তে চীন ও রাশিয়াই ভারতের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
মোদি দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছেন যাতে ভারতের জিডিপি হঠাৎ তীব্রভাবে না কমে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞ আগাম সতর্ক করে বলেছেন, জিডিপি প্রায় অর্ধশতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। ভারত সরকারের এক সূত্র বলেছে, ট্রাম্পসৃষ্ট বিশাল সংকট সামাল দিতে ভারত চীনের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং একই সঙ্গে পুরোনো সমস্যাগুলো মোকাবিলায় সতর্ক থাকবে, জাতীয় স্বার্থ মাথায় রেখে।
লক্ষণীয় যে মাসের শেষে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য মোদির চীন সফর জাপান সফরের সঙ্গে একত্রে পরিকল্পিত। তাঁর পরিকল্পনা হলো ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ নিয়ে ভ্রান্ত প্রত্যাশা পেছনে ফেলে দ্রুত বাস্তবতা মেনে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করা।
গোপনে, যেমনটা এখন বিশ্বের অনেক রাজধানীতেই ঘটছে, নয়াদিল্লির রাইসিনা হিলে এক বাস্তবতা উপলব্ধি তৈরি হয়েছে। সেটি হলো ভারত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ও তাঁর মাগা এজেন্ডা সঠিকভাবে মূল্যায়নে ভুল করেছে।
দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চীনবিষয়ক কূটনীতিতে ভারতের কোনো গুরুত্ব নেই। আসলে মার্কিন কংগ্রেসে এখন পররাষ্ট্র দপ্তর কার্যত ক্ষমতাহীন, আর স্টিভ উইটকফের মতো রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত প্রভাব খাটাচ্ছেন। মার্কিন সরকারের পুরোনো কূটনৈতিক ব্যবস্থাগুলো বিনা নোটিশে ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্পের ব্যবসায়িক মনোভাব মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দীর্ঘদিনের নীতিকে আড়াল করে দিয়েছে।
চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের সঙ্গে বহুপক্ষীয় সম্পর্কে ভারতের নতুন কৌশল ট্রাম্পের কারণেই, যিনি মোদিকে দুটি অস্বস্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য বিকল্প দিয়েছিলেন।
প্রথমত, কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কি কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারেন যে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁকে পাকিস্তান বিষয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দিয়েছেন, বিশেষত যখন ট্রাম্প সত্যকে গোপন করে কথা বলেন?
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রতি ট্রাম্পের বিস্ময়কর অজ্ঞতা ও সংবেদনশীলতার অভাবই সমস্যার মূল। তিনি মোদিকে এমন একটি প্রকাশ্য বিকল্প প্রস্তাব করেছিলেন, যা তিনি কখনোই গ্রহণ করতে পারেন না। নয়াদিল্লিতে কোনো রাজনৈতিক নেতা এমন প্রস্তাব একমুহূর্তও বিবেচনা করবেন না। হয়তো এ উপলব্ধিই ট্রাম্পকে বিরক্ত করছে।
দ্বিতীয়ত, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোদির ওয়াশিংটন সফরের সময় ট্রাম্প ভারতীয় কৃষি ও দুগ্ধ বাজারে মার্কিন প্রবেশাধিকার চেয়েছিলেন। এ বিষয়গুলো পরবর্তী বাণিজ্য আলোচনায়ও তোলা হয়। এর পর থেকে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভারতে কৃষিসংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর মতোই সংবেদনশীল।
ভারতীয় সূত্রগুলোর দাবি, মার্চ থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা স্পষ্ট করে যে ভারতের কৃষি ও দুগ্ধশিল্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত করার প্রশ্নটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো গুরুতর ইস্যু হয়ে উঠেছে। এ কারণেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল রাশিয়া ও চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন।
ট্রাম্পের দলের সদস্যরা ভারতের দুগ্ধ সমবায় ব্যবস্থা ও কৃষিভিত্তিক সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না রেখেই এমন কিছু চাইছেন, যা কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মেনে নিতে পারবেন না। প্রতিবারই ভারত-মার্কিন আলোচনাকারী দল নানা সমঝোতার পর বাণিজ্যচুক্তির খসড়া তৈরি করে হোয়াইট হাউসে পাঠাত, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হতো।
কেন? অধিকাংশের ধারণা, ট্রাম্প তাঁর মাগা–সমর্থকদের দেখাতে চেয়েছিলেন, ‘দেখো, আমার বন্ধু মোদি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ১৪০ কোটি মানুষের বিশাল বাজার খুলে দিয়েছে।’ তিনি অবিবেচকভাবে ভেবেছিলেন, ভারতীয় ক্রেতারা ভুট্টা, সয়া, গরুর মাংস, চিজ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছেন, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী ভারতের প্রতি অ-কূটনৈতিক, অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য দাবি উপস্থাপন করছে।
ভারতের কৃষিশিল্পে ট্রাম্প যে ধরনের ছাড় চাইছেন, তা কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দিতে পারবেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির জন্য এটি কার্যত অসম্ভব। ট্রাম্প শুল্ক কমাবেন, এমন আশা খুবই ক্ষীণ।
২৭ আগস্টের সময়সীমা যত ঘনিয়ে আসছে, ভারতের শীর্ষ মহল পুরোপুরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলে নেমেছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঝুঁকি বিশ্লেষণ করছে, আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতীয় দূতাবাসগুলো নতুন বাজার খুঁজছে।
আসন্ন সংকট মোকাবিলার জন্য জিএসটি কাঠামোয় সংস্কারসহ অন্যান্য পদক্ষেপের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে না এলে মোদি সরকারকে রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। এ পরিস্থিতিতে একমাত্র আশা, ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা দ্রুত তাঁদের পণ্যের জন্য বিকল্প বাজার খুঁজে পাবেন। শুল্ক-সন্ত্রাস বাস্তব।
চীনের সঙ্গে কূটনীতির পথ পরিবর্তন থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে ভারত সরকার বাস্তবতাকে অস্বীকার করছে না। শীলা ভাট দিল্লিভিত্তিক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। দ্য প্রিন্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ