স্বৈরাচার কাকে বলে? প্রশ্নটির সাধারণ উত্তর- অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী মাত্রই স্বৈরাচার। এ কথা সত্য বটে। তবে নির্বাচিত সরকার স্বৈরাচার নয়, এটা বলাও আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক নয়। সামরিক শাসকরাই কেবল স্বৈরাচার, নির্বাচিত সরকারগুলো গণতান্ত্রিক, আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না। মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ও সুযোগ হরণ করে রাষ্ট্রের নানা বাহিনী লেলিয়ে দেশ শাসনের অগণতান্ত্রিক নজির নির্বাচিত সরকারগুলোও করতে কসুর করেনি। তাই নির্বাচিত সরকারগুলো স্বৈরাচারের কলঙ্কমুক্ত বলার উপায় নেই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা প্রতিটি সরকার কমবেশি স্বৈরাচারী আচরণের নজির রেখেছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশবাসী তাদের মৌলিক অধিকার কখনও ভোগ করতে পারেনি। ভোট প্রয়োগের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার অংশ মাত্র। পূর্ণাঙ্গ নয়। নির্বাচিত সরকারের আমলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সুযোগ কোনোভাবেই নিশ্চিত হয়নি। সে বিবেচনায় নির্বাচিত সরকারগুলোকেও গণতান্ত্রিক বলার উপায় নেই। অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমরা অতিক্রম করেছি স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর।
আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ বীর শহীদের আত্মদান এবং শত-সহস্র নারীর সম্ভ্রম হারানোর ত্যাগে ভূখণ্ডের স্বাধীনতা এসেছে। তবে সব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত হয়নি। কেবল শাসক বদল হয়েছে। ভিনদেশি শাসকের স্থলে স্বদেশি রাজনৈতিক ও সামরিক শাসক পেয়েছি। এতে রাষ্ট্রের সব বিধিব্যবস্থা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। ১৫ আগস্টের ইতিহাসের কলঙ্কজনক রক্তাক্ত ঘটনার পর সামরিক শাসকরা দীর্ঘ মেয়াদে দেশ শাসন করেছেন। অনেক আত্মদান-ত্যাগের বিনিময়ে নব্বইয়ের সফল গণ-অভ্যুত্থানে জাতি সামরিক স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল। আশা ছিল, দেশে গণতান্ত্রিক সুবাতাস বইবে। কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারমুক্ত দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার সামরিক সরকারের সংস্কৃতিমুক্ত হতে পারেনি। দেশ শাসনে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে দেশ শাসন করেছে। নির্বাচিত হলেও তাদের গণতান্ত্রিক কিন্তু বলা যাবে না। সামরিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থারই বেসামরিক সংস্করণ মাত্র।
দেশে এখন নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে হট্টগোল বেধেছে। তর্ক-বিতর্ক এবং সংঘাতেরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে সর্বমহলে তোলপাড় চলছে। অথচ দেশবাসীর দুর্ভোগ-দুর্গতি নিয়ে কেউ শঙ্কিত নয়। তাদের বাঁচা-মরা নিয়েও নেই কারও সামান্য উদ্বেগ-চিন্তা। সরকার ও রাজনৈতিক দলের তো নেই-ই। এমনকি তথাকথিত সুশীল সমাজেরও এ বিষয়ে মুখে শব্দ নেই। কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে নানা কথামালার সীমাহীন আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে সব রাজনৈতিক দল অতীতে সোচ্চার হয়েছিল, করেছিল আন্দোলন-সংগ্রাম- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সে ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। অন্যদিকে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কেবল অগ্রাহ্যই করেনি, একতরফা প্রহসনমূলক নির্বাচন পর্যন্ত সম্পন্ন করেছিল। কী নির্মম পরিহাস, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অগ্রাহ্যকারী বিএনপি জোট পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে মাতম করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল। এমনকি সে নির্বাচন হতেও দেবে না বলেছিল। শাসক শ্রেণির দুই প্রধান দলের ক্ষমতায় থাকা আর না থাকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে দেশবাসীর চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার দশা। অথচ দেশবাসীর ভোটেই এদের যে কোনো এক দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরম্পরা চলছিল। অর্থাৎ জনগণই নির্ধারণ করেছে তারা শাসক দুই দলের কোন দল দ্বারা শাসিত-নিগৃহীত হবে। সেটা নির্ধারণের জন্যই নির্বাচন। দেশের এবং মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এযাবৎকালে কোনো নির্বাচনই ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রতিবার নির্বাচনে শাসকদলের বদল হয়েছে কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। শাসকদলের আদর্শিক মতপার্থক্য কিন্তু নেই। উভয় দল পুঁজিবাদের অনুসারী-অনুগামী এবং সাম্রাজ্যবাদে অনুগত। বাইরে তারা ভিন্ন হলেও ভেতরে কিন্তু সমানে সমান।