যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই দর–কষাকষি করছে বাংলাদেশ। উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে ট্রাম্প প্রশাসনের ধার্য করা উচ্চ শুল্ক কমিয়ে আনা।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ৬০টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের জন্য প্রথমে এ হার ছিল ৩৭ শতাংশ, সর্বশেষ তা ৩৫ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। দর-কষাকষি হচ্ছে এই হার কমিয়ে আনার জন্য। দুই দফা আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি। এখন তৃতীয় দফা আলোচনার প্রস্তুতি চলছে।
শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কী কী শর্ত দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি। কারণ হিসেবে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, এ বিষয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) রয়েছে। তাই বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি করতে চাইছে, যেখানে তাদের নিরাপত্তা, কৌশলগত স্বার্থ, অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত না বলা হলেও বিভিন্ন সূত্র ধরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, শুল্ক নিয়ে দর–কষাকষির নামে এমন সব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, যেগুলো জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের শুল্ক কমানোর শর্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চীন থেকে সামরিক ও প্রযুক্তিগত কেনাকাটা কমানো, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জাম, উড়োজাহাজ, এলএনজি, গম, সয়াবিনসহ বিভিন্ন কৃষি ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য আমদানি বৃদ্ধি ও সহজ করার শর্ত দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা দূর করার শর্ত হিসেবে মার্কিন বিভিন্ন মানদণ্ড বাংলাদেশকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে যেন মার্কিন পণ্য অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নের শর্ত দিয়েছে। সেই সঙ্গে কঠোর ‘রুলস অব অরিজিনের’ (কোনো দেশের উৎপাদিত পণ্য তা ঠিক করার নিয়ম) প্রস্তাব করেছে। এতে মার্কিন বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশি পণ্যে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রয়োজন হবে।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত হচ্ছে, দেশটি অন্য কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, তা অন্য কোনো দেশকে না দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, এ চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনীতি, আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রযুক্তি খাতের ওপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সেই সঙ্গে চাইছে চীন ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সীমিত করতে।
ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে বড় ধরনের বাধা তৈরি হবে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এখন পোশাক খাতের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেশটাকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, যদি কোনো কারণে ৪০ হাজার কোটি ডলারের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮০০ কোটি ডলারের অর্জন বিসর্জন দিতে হতে পারে। (যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার বসতে চায় বাংলাদেশ, প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০২৫)
বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকশিল্পের পুরো বাজারই হাতছাড়া হয়ে যাবে, ব্যাপারটি এ রকম নয়। শুল্কহার শুধু বাংলাদেশেরই বাড়ছে না, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বেশি পোশাক সরবরাহকারী দেশে চীনের জন্যও বাড়ছে। পোশাকশিল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে মনে করছেন, নতুন ঘোষিত শুল্কহারে চীনের রপ্তানি অনেক কমে যাবে। এ কমে যাওয়া রপ্তানিটুকু বাংলাদেশ, ভারত ও ভিয়েতনাম মিলেও সরবরাহ করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ মূলত কম দামের পোশাকপণ্য বেশি প্রস্তুত করে। ভিয়েতনাম যদি যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি শুল্ক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে দেশটিতে ক্রয়াদেশ মূলত আসবে চীন থেকে। কারণ, চীন বেশি দামের পোশাকপণ্য বেশি উৎপাদন করে। ফলে বাংলাদেশের সক্ষমতার যে ক্ষেত্র, অর্থাৎ কম দামি পোশাক, সেটি হাতছাড়া হওয়ার কারণ নেই।
তবে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের শুল্ক বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কম হলে বাংলাদেশ কিছুটা বাজার হারাতে পারে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রয়াদেশ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে বলে ধারণা করছেন পোশাক রপ্তানিকারকেরা। (প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ওপর ঘোষিত শুল্কহার বেশি, বণিক বার্তা, ১৪ জুলাই ২০২৫)
অন্যদিকে যেনতেনভাবে শুল্ক কমাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তগুলো মেনে নিলে পুরো দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে, তা অপরিমেয় ও সুদূরপ্রসারী। এক ৪০ শতাংশ রুলস অব অরিজিনের শর্ত মানতে হলেই চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে কিছুটা মূল্য সংযোজন করে রপ্তানি করা কারখানাগুলো বিপদে পড়বে। বাংলাদেশকে অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য আমদানি, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সব দিক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যেন জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের মালিকদের মুনাফা ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের কথা যেমন ভাবতে হবে, তেমনি দেশের অন্যান্য খাতের বিকাশের কথাও মাথায় রাখতে হবে।
এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যবসায়ী বা আমলাদের সঙ্গে পরামর্শই যথেষ্ট নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন যেকোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সংসদে আলোচনা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বিদেশিদের কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশে বাধা হতে পারে, দেশের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে তা বাধা হতে পারে না। সরকারের আমলা ও উপদেষ্টারা চুক্তির শর্ত সম্পর্কে জানতে পারলে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কেন জানতে পারবেন না, তা বোধগম্য নয়। দেশের জনগণকে না জানিয়ে ও রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না করে এ রকম সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের এককভাবে নেওয়ার এখতিয়ার নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির বেলায় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন আর শিশু অবস্থায় নেই। চার দশকের পরিক্রমায় ইতিমধ্যে নানা ধরনের ঝড়ঝঞ্ঝা পার করে আসার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উন্নয়নশীল দেশের জন্য পোশাক রপ্তানি কোটা উঠে যাওয়ার সময়ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল মার্কিন বাজার হারানোর। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সেটি সফলভাবেই মোকাবিলা করেছে।
এখন সময় এসেছে পোশাকশিল্পের একক বাজারনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার। সেই সঙ্গে বাংলাদেশকেও একক রপ্তানি পণ্যনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একদিকে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদানির্ভর টেকসই শিল্পায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। যেন একক রপ্তানি পণ্য ও একক বাজারের বিষয়টিকে ব্যবহার করে কোনো দেশ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ‘ব্ল্যাকমেল’ করতে না পারে। কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে