১৭ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আবারো টানাপড়েনের পথে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

শীতল যুদ্ধের সময়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ছিল সংশয়ের, অবিশ্বাসের ও দূরত্বের। একদিকে সোভিয়েতঘনিষ্ঠ ভারত, অন্যদিকে পাকিস্তানঘেঁষা যুক্তরাষ্ট্র। এ ভূকৌশলগত বিভাজনে দুই দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দ্বিধান্বিত সম্পর্কের দীর্ঘ অধ্যায়। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব ও নিরাপত্তা কৌশল একসঙ্গে মিলে দুই রাষ্ট্রকে কাছাকাছি আনে। কোয়াড জোট, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মঞ্চে ভারত হয়ে ওঠে ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ট্রাম্প ও মোদির পারস্পরিক রসায়নও সেই উষ্ণতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে ফেরেন দিল্লিতেও বেজেছিল ঢোল-নাগড়া। এক সময় মোদি বলেছিলেন ‘আবকি বার, ট্রাম্প সরকার’। আর ট্রাম্প বলেছিলেন ‘হাউডি মোদি’। কূটনীতিক মহলে আলোচনা ছিল ট্রাম্প ফিরলে ভারত ‘স্পেশাল ট্রিটমেন্ট’ পাবে। কিন্তু ছয় মাস পেরোতেই উল্টো চাপের মুখে ভারত। ওই ‘মিষ্টি মুহূর্ত’ ভেঙে এখন শুরু হয়েছে শুল্কের কশাঘাত, বাণিজ্যযুদ্ধ।

গত ৩১ জুলাই ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনায় ক্ষুব্ধ ট্রাম্প গত ০৫ আগষ্ট নয়াদিল্লির ওপর চাপিয়েছেন আরো ২৫ শতাংশ শুল্ক। ফলে ভারতীয় পণ্যে মোট শুল্ক দিতে হবে ৫০ শতাংশ। ০৫ আগষ্টই ডোনাল্ড ট্রাম্প এ-সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে সই করেছেন। আজ থেকে ২০ দিন পর এ শুল্ক কার্যকর হবে। পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারতও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অন্যায়’। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের নতুন দুয়ার খুলল হোয়াইট হাউজ, যা বদলে দিতে পারে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সমীকরণ। বদলে দিতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিও।

কিন্তু ভারতের ওপর কেন এত ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যে ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারছেন না তার খেসারত দিতে হচ্ছে নয়াদিল্লিকে। আলোচনায় না পেরে রাশিয়ার তেল বাণিজ্যে আঘাত করতে চান ট্রাম্প। সেখানে রুশ তেলের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারতের তেল আমদানির তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান ছিল প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। মাত্র দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু যুদ্ধের পর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশে, যা দৈনিক প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল। এতে রাশিয়া গত বছর ভারত থেকে প্রায় ৪১ বিলিয়ন পাউন্ড আয় করেছে বলে জানায় গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ।

কিন্তু ভারত তো রুশ তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা চীন। রুশ তেলের ৪৭ শতাংশ রফতানিই যায় সেখানে, ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। তৃতীয় অবস্থানে তুরস্ক। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের লক্ষ্য শুধুই ভারত কেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এ বাছাইকৃত কৌশল কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও এর পেছনে রয়েছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বছরের শেষ নাগাদ একটি সফল বৈঠকের আশা করছেন ট্রাম্প। ফলে চীনের ওপর চাপ না দেয়ার পথেই হাঁটছেন তিনি। তুরস্কের ক্ষেত্রেও একই মনোভাব। বিপরীতে ওয়াশিংটনের চোখে ভারত এখন ‘অতি নিরপেক্ষ’ অবস্থান নেয়ার কারণে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন এ পদক্ষেপ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরো দুর্বল করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও ভারতকে ঘিরে কূটনৈতিক উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। কোয়াডের সক্রিয় সদস্য, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মূল স্তম্ভ এবং ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর কণ্ঠস্বর হিসেবে ভারতের অবস্থান ছিল অনেকটা ভারসাম্যের কেন্দ্রে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে গুরুত্ব পাওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে সুদীর্ঘকালের বন্ধুত্বের বিরল সুবিধা উপভোগ করছিল নয়াদিল্লি। একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা মিলিয়ে ভারত এক ‘ভূরাজনৈতিক সুইট স্পট’-এ পৌঁছেছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ট্রাম্পের পাশাপাশি ইইউও ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ রুশ তেল কেনার কারণে।

এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্কের ইতিহাস জটিল, দ্বিধান্বিত ঘনিষ্ঠতার কথাই বলে। সত্তরের দশকে শীতল যুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত-ভারতের ঘনিষ্ঠতার বিপরীতে আমেরিকার ছিল পাকিস্তানঘেঁষা কৌশল, যা পারস্পরিক অবিশ্বাস তৈরি করেছিল দীর্ঘদিন। পরবর্তী দশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দুটি একে অপরের কাছাকাছি এসেছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিশাল বাজার। অ্যাপল, অ্যামাজন, বোয়িং থেকে শুরু করে টেসলা পর্যন্ত—সবাই ভারতের ডিজিটাল ও প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ভবিষ্যতের গ্রাহক হিসেবে দেখছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা পিএলআই স্কিমের মতো প্রকল্পগুলোয় মার্কিন বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ১৩১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে। প্রায় দুই হাজার মার্কিন কোম্পানি ভারতে কাজ করছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা প্রায় সাড়ে চার লাখ চাকরি সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মর্গান স্ট্যানলি এক সময় ভারতকে ‘ফ্রাজাইল ফাইভ’ তালিকায় রাখলেও আজ তা রূপ নিয়েছে ‘ফ্যাবুলাস ফাইভ’-এ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৫ লাখ ভারতীয় অভিবাসী উভয় দেশকে একটি মূল্যবোধভিত্তিক বন্ধনে রেখেছে। কেবল অর্থনীতি নয়, ভারত এশিয়ায় চীনের পাল্টা একটি গণতান্ত্রিক কৌশলগত ভারসাম্যও।

তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক আবার বদলে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট ভারতীয় রাজনীতিক, কূটনীতিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী শশী থারুর। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ভারত হয়তো নীতিগত পরিবর্তনের পথে হাঁটবে। ট্রাম্প-মোদি ‘বন্ধুত্ব’ যেভাবে ভেঙে যাচ্ছে, তা ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘আদর্শভিত্তিক’ নয়, বরং ‘স্বার্থভিত্তিক’ সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ কোনো চুক্তির বাধ্যবাধকতা না থাকায় ভারত যেমন জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর নয়, তেমনি চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের নতুন পথ খুঁজছে। এ বছরের জুলাইয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের বেইজিং সফরই তার প্রমাণ।

বিশ্ব রাজনীতিতে ভূরাজনীতিক শক্তির হিসাব যখন রীতিমতো পাল্টে যাচ্ছে, তখন এ শুল্কনীতি ভারতকে শুধু কূটনৈতিক চাপে ফেলবে না, বরং বৈশ্বিক ভারসাম্যেরও অংশ হয়ে উঠবে—এমনটাই ধারণা বিশ্লেষকদের।