এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে দুই উইকেটে হারালো। তিন উইকেট নিলেন রিশাদ ও মুস্তাফিজ।
ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা, নিজেদের ব্যাটিং আর বোলিংয়ের মধ্যে দিয়ে ইনিংসের শুরুতে। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করে শেষ হাসি বাংলাদেশের। আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেনিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে দুই উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ, যার ফলে দুই ম্যাচে দুই হারে শ্রীলঙ্কার পরের পর্বে যাওয়ার সমীকরণটা হয়ে গেছে কঠিন।
জিততে হলে ১২০ বলে করতে হবে মাত্র ১২৫ রান। এমন ম্যাচেও ইনিংসের দ্বিতীয় বলে যেভাবে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন সৌম্য সরকার, তাতে রান তাড়ায় শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ২৮ রান তুলতেই তিন উইকেট নেই, সৌম্য শূন্য, তানজিদ হাসান তামিম তিন, আর নাজমুল হোসেন শান্ত সাত রান করে আউট। এমন পরিস্থিতিতে ১২৫ রানও এভারেস্টের সমান। সেই দুর্গম যাত্রাটাই সম্ভব হচ্ছিল লিটন দাস (৩৬) আর তাওহিদ হৃদয়ের (৪০) ব্যাটে। ভানিন্দু হাসারাঙ্গাকে টানা তিন ছক্কায় সমীকরণ যখন সহজ করে আনলেন হৃদয়, তারপরই ব্যাটিং ধ্বস। হৃদয় আউট, পরের ওভারে লিটন। অল্প রানে বিদায় সাকিবেরও (আট)। তুষারার পরপর দুই বলে নেই রিশাদ এবং তাসকিনও। আট উইকেট যখন পড়ে গেছে, জয় তখনো ১২ রান দূরে। শেষটায় আর কোনো অঘটন হতে দিলেন না মাহমুদউল্লাহ। দাসুন শানাকার করা ম্যাচের ১৯তম ওভারের প্রথম বলটাই ছিল ফুলটস আর তাতেই ছক্কা মেরে ব্যবধান কমিয়ে আনেন অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার। এরপর দুই বার দুজনের প্রান্ত বদল, একটা অতিরিক্ত রান আর ওভারের শেষ বলে ওভার থ্রো’র কল্যানে নেয়া দুই রানে নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের দুই উইকেটের জয়।
ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে টসে জিতে বোলিং নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। তিন পেসারে একাদশ সাজায় বাংলাদেশ, সঙ্গে লেগস্পিনার রিশাদ হোসেন। জায়গা হয়নি অফস্পিনার শেখ মেহেদি হাসানের, বাইরে ছিলেন জাকের আলি অনিকও। শরিফুল ইসলাম খেলতে পারছেন না চোটের কারণে।
পাওয়ার প্লে’তে শ্রীলঙ্কা দলের পারফরম্যান্স দেখে বাংলাদেশে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে যারা টিভি খুলেছিলেন, তাদের অনেকেই নিশ্চয় আফসোস করছিলেন। কারণ পাথুম নিশাঙ্কা তখন বেধড়ক মারছেন! সাকিব আল হাসানের দ্বিতীয় আর ম্যাচের পঞ্চম ওভারে নিশাঙ্কা মারলেন চারটা বাউন্ডারি। প্রায় প্রতি ওভারেই বাউন্ডারি আসছে। তাসকিন আহমেদকে টানা দুই বাউন্ডারি মারার পর ইনসাইড-এজ হয়ে বোল্ড হয়ে যান কুশল মেন্ডিস। বাংলাদেশ পায় প্রথম সাফল্য। কিন্তু তাতেও রান তোলার গতি কমেনি, কারণ, উইকেটে এসে কামিন্দু মেন্ডিসও প্রথম বলেই মারলেন বাউন্ডারি। পাওয়ার প্লে’তে নয়টি বাউন্ডারি আর একটি ছক্কায় শ্রীলঙ্কার দুই উইকেটে ৫৩ রান, রান-রেট নয়-এর কাছাকাছি। এখান থেকে বড় সংগ্রহ খুবই সম্ভব মনে হচ্ছে। এতখানি দেখে হতাশ হয়ে যারা ফের ঘুমাতে চলে গিয়েছেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ। কারণ বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য এক প্রত্যাবর্তনের গল্পের শুরুটা সেখান থেকেই।
ম্যাচের নবম ওভারের পঞ্চম বল, ওভারটা করছিলেন মোস্তাফিজ। আগের বলেই মিড-উইকেট দিয়ে চমৎকার বাউন্ডারি মেরেছেন নিশাঙ্কা। হাফ সেঞ্চুরি চলে এসেছে হাতের নাগালে। মোস্তাফিজের বলটায় ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ডেলিভারিটা ছিল তার সেই বিখ্যাত স্লোয়ার কাটার। বলটা উঠে গেল হাওয়ায়,কভারে নাজমুল হোসেন শান্ত ক্যাচটা নিতে কোন ভুল করলেন না। নিশাঙ্কার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন শ্রীলঙ্কার রান তোলার গতিটাও কমে এল, ম্যাচে ক্রমে ফিরতে শুরু করলেন বাংলাদেশের বোলাররা।
১৫তম ওভারে রিশাদকে ফের বোলিংয়ে আনলেন অধিনায়ক। ম্যাচে তার তৃতীয় ওভার, তার আগে দুই ওভারে ১৬ রান দিয়ে কোন উইকেট নেই। প্রথম বলেই চারিথ আসালাঙ্কা উড়িয়ে মারতে গেলেন মিড-উইকেট দিয়ে, সেদিকটা মাঠের সবচেয়ে বড় সীমানা। একটু ফস্কালেও শেষ পর্যন্ত ক্যাচটা ধরে ফেললেন সাকিব। পরের বলেই দেখা গেল সেই দৃশ্য, যার জন্য অপেক্ষা অনেক দিনের। বাংলাদেশের একজন লেগস্পিনারের ধ্রুপদি লেগস্পিন ডেলিভারিতে বিভ্রান্ত হয়ে ব্যাটসম্যানের স্লিপে ক্যাচ দেয়া! রিশাদের বলে এভাবেই সৌম্য সরকারের হাতে ক্যাচ দিয়ে শূন্য রানে আউট হয়ে যান ভানিন্দু হাসারাঙ্গা। পরপর দুই বলে দুই উইকেট রিশাদের, তাতেই উজ্জীবিত বাংলাদেশ আর কোণঠাসা শ্রীলঙ্কা। এরপর শ্রীলঙ্কা উইকেট হারিয়েছে নিয়মিতই, প্রায় প্রতি ওভারেই উইকেট তুলে নিচ্ছিলেন বাংলাদেশের কোন না কোন বোলার। পাওয়ার প্লে’তে বাউন্ডারির বন্যা বইয়ে দেবার পর দীর্ঘ খরা,১১তম ওভারের পঞ্চম বলে হওয়া বাউন্ডারির পর শ্রীলঙ্কা বাউন্ডারির দেখা পেয়েছে শেষ ওভারের প্রথম বলে। মাঝে ৫৭ বলে কোন বাউন্ডারি মারতে পারেননি শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা। ২০ ওভারে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ নয় উইকেটে ১২৪ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৭ রানে অলআউট হবার মত লজ্জাজনক কান্ড হয়তো ঘটেনি, তবে ছয় ওভারে দুই উইকেটে ৫৩ রান থেকে ২০ ওভারে নয় উইকেটে ১২৪ রান নিঃসন্দেহে তাদের ব্যাটিংয়ের ভাল উদাহরণ নয়।
এই অল্প রান তাড়াতেই বাংলাদেশ টপ অর্ডারের ‘হার্ট-অ্যাটাক ব্যাটিং’ ম্যাচটাকে কঠিন করে তোলে বাংলাদেশের জন্য। ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেও শূন্য রানে আউট হয়েছেন এই বামহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসেও আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে, সবশেষ চার ইনিংসে তিন শুন্যতে প্রকৃত অর্থেই সৌম্য হয়ে উঠেছেন শূন্য সরকার! তানজিদ হাসান তামিম বোল্ড হয়েছেন নুয়ান তুষারার বলে আর নাজমুল হোসেন শান্ত ড্রাইভ করতে গিয়ে বল তুলে দেন শর্ট এক্সট্রা কাভার ফিল্ডারের হাতে। এই বিপর্যয় থেকে দলকে বাঁচিয়েছেন লিটন দাস আর হৃদয়,৩৮ বলে ৬৩ রানের জুটি গড়ে। তবে তাদের দ্রুত বিদায়ের সঙ্গে আরো অনেকেই তাদের অনুগামী হলে হারের আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের, শেষদিকে মাহমুদউল্লাহ’র ১৩ বলে অপরাজিত ১৬ রানের ইনিংসটার মূল্য তাই অনেক বেশি। কারণ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে জয়ের মুখ দেখিয়েছে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ’র ইনিংসটাই।
এই নিয়ে পরপর দুটো বিশ্বকাপ আসরে শ্রীলঙ্কাকে হারাল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের একদিনের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ আর ডালাসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে খুব সম্ভবত তাদের দ্রুত দেশে ফেরারই ব্যবস্থা করে দিলো। এক ওভার হাতে রেখে পাওয়া দুই উইকেটের জয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযান পেল ফিরে পেল উদ্দীপনা, দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে জোরালো ভাবেই। বাংলাদেশের পরবর্তী ম্যাচ ১০ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে,নিউ ইয়র্কে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা ১২৪/৯; নিশাঙ্কা ৪৭, ডি সিলভা ২১, রিশাদ ৩/২২, মোস্তাফিজ ৩/১৭
বাংলাদেশ ১৯ ওভারে ১২৫/ ৮; হৃদয় ৪০,লিটন ৩৬, তুষারা ৪/১৮ : – সামিউর রহমান, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে