১১ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অর্থনীতি

মার্কিন পাল্টা শুল্কের প্রভাব, রপ্তানিতে ইউরোপমুখী চীন বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা

মার্কিন পাল্টা শুল্কের প্রভাব, রপ্তানিতে ইউরোপমুখী চীন বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ‘পাল্টা শুল্ক’ রপ্তানি বাণিজ্যের গতিধারা পাল্টে দিচ্ছে। উচ্চ শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বদলে ক্রমেই ইউরোপমুখী হয়ে উঠছে চীন। দেশটি ২৭ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাক রপ্তানি বাড়াচ্ছে। এর প্রভাবে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। তাদের রয়েছে নিজস্ব কাঁচামাল, লিড টাইমের সুবিধা। লিড টাইম হচ্ছে রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়। বেশি উৎপাদনশীলতার সুবিধায় রপ্তানি প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে চীন। ইইউতে জোটে চীনের রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়টিকে উদ্বেগের বলছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। তারা মনে করেন, ইইউ জোটে আগামীতে চীনের রপ্তানি আরও বাড়তে পারে, বিপরীতে কমতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি।

ইইউর সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, একক মাস হিসেবে গত জুলাইয়ে ইইউ জোটে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। মাসটিতে চীনা পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। অথচ কয়েক মাস আগেও দুই দেশের রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে এতটা ব্যবধান ছিল না।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাস অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে ইইউ জোটে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রতিযোগী সব দেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। ওই দুই মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি ছিল। তখন চীনের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ শতাংশ। আবার জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বছরের প্রথম সাত মাসের গড়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ওই সময় চীনের রপ্তানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ ইউরোস্ট্যাটের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু জুলাই মাসে চার গুণ বেশি রপ্তানি সত্ত্বেও সাত মাসের গড় হিসাবে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় কাছাকাছি।

গত ২ এপ্রিল সব দেশের পণ্য আমদানিতে ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশহ ৬৫ দেশের পণ্যে অতিরিক্ত বিভিন্ন হারে ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। দফায় দফায় ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের কথাও শোনা যায়। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন ইউরোপমুখী হবে বলে আশঙ্কার কথা বলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য বিশ্লেষক ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, চীন ও ভিয়েতামের পণ্য আমদানিতে অস্বাভাবিক শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশ দুটির পণ্য রপ্তানি কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে চীনা পণ্য রপ্তানি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এতে বাধ্য হয়ে অন্য বাজারগুলোতে চীনা পণ্য অন্যান্য দেশের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকার পরিস্থিতিতে দর কমানোর চাপ দেওয়ার সুযোগ নেবে ইইউর বাজারের ব্র্যান্ড-ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ রকম প্রবণতায় সাধারণত রপ্তানি কমে যায়।

ইউরোস্ট্যাটের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, জুলাই মাসে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল ১৬৮ কোটি ডলরের কম। চীনা পোশাকে যা ছিল ২৭৮ কোটি ডলারেরও বেশি। অন্যদিকে বছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল এক হাজার ১৯৭ কোটি ডলারের। চীনের ছিল এক হাজার ৪০৬ কোটি ডলারের। ওই সাত মাসে ইইউর পোশাক আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়েছে। মোট পাঁচ হাজার ১৯২ কোটি ডলারের পোশাক গেছে জোটে।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সমকালকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের কথা শোনা গেছে। পরে সেটা কমে হয়তো ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ হয়েছে। ঠিক কত শুল্কহার ঠিক করা হয়েছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা কাটেনি। তবে শুল্ক যতই হোক, তা বাংলাদেশের পণ্যের চেয়ে দ্বিগুণ বা কয়েক গুণ।

তিনি বলেন, এত বেশি শুল্ক এড়াতে খুব স্বাভাবিক কারণেই চীন জোট হিসেবে সবচেয়ে বড় বাজার ইইউতে হিস্যা বাড়াতে চায়। তার সুফলই পাচ্ছে তারা। নিজস্ব কাঁচামাল, কম লিড টাইম, বেশি উৎপাদনশীলতায় তারা তো আগে থেকেই আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। আমাদের এখন উচিত শুল্কমুক্ত সুবিধার সর্বোচ্চ সদ্ব্যব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বাজার ইইউতে মনোযোগ আরও বাড়ানো।

এদিকে ইইউর বাজারে শীর্ষ রপ্তানিকারক ১০ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তালিকায় শীর্ষস্থানে বরাবরের মতো চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্যান্য বাজারের মতো ইইউর বাজারে রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় নেই ভিয়েতনাম। দেশটির অবস্থান ষষ্ঠ। তুরস্ক সেখানে তৃতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে যথাক্রমে ভারত ও কম্বোডিয়া। তালিকায় পাকিস্তান সপ্তম, মরক্কো অষ্টম, শ্রীলঙ্কা নবম ও ইন্দোনেশিয়া দশম অবস্থানে রয়েছে।