বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত বাড়ছে তাপমাত্রা। গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভয়াবহ বন্যা, খরা, দাবানল এবং ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এসবের মাঝে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই সব জনগোষ্ঠী, যারা জলবায়ু সংকট সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে কম দায়ী। একে বৈজ্ঞানিকরা বলছেন ‘জলবায়ু বৈষম্য’ হচ্ছে একটি সামাজিক ও পরিবেশগত অবিচার।
বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই সতর্ক করে আসছেন। শিল্পবিপ্লবের আগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যা ছিল, বর্তমানে তা থেকে প্রায় ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। যদি এটি ১.৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়, তবে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে এমন সব পরিবর্তন ঘটবে যেগুলোর প্রভাব হবে অপরিবর্তনীয়।
এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। আর্কটিক অঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে গড়ের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ হারে। ফলে বরফ গলে গিয়ে তাপমাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে a vicious cycle. দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। কৃষির ওপর এর প্রভাব পড়ছে ভয়াবহভাবে। অনেক এলাকায় শস্য উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অন্যদিকে, বৃষ্টিপাতের মাত্রা ও সময় বদলে যাওয়ায় বাড়ছে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়—বর্তমানের বাস্তবতা মোকাবিলা করছে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ছে, চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। বছরে হাজার হাজার পরিবার বসতভিটা হারিয়ে শহরমুখী হচ্ছে। জাতিসংঘের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই এক কোটির বেশি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে। ঢাকার মতো শহরগুলোতে এই জনস্রোত নতুন চাপ সৃষ্টি করছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন কেবল পরিবেশ নয়, স্বাস্থ্য খাতেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগের প্রকোপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় তেরো লক্ষ মানুষ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মারা যায়। এ সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে আশার কথা হলো- এই সংকট এখনও রোধ করা সম্ভব। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের হার বেড়েছে, সৌর ও বায়ু প্রযুক্তির ব্যয় অনেক কমেছে এবং অনেক দেশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে নীতিগত উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো এখনও পর্যাপ্ত নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজন এবং ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় যে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন, তা অনেকাংশেই অপ্রতুল। প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিল এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশ্বের ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করলেও সবচেয়ে বেশি ভুগছে দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলো। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু প্রতিশ্রুতিতে নয়- বাস্তব পদক্ষেপে তা প্রতিফলিত করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করে অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অভিযোজন কৌশলে নেতৃত্ব দিতে হবে।
এখন সময় এসেছে ভবিষ্যতের কথা ভাবার। কারণ জলবায়ু সংকট আর কোনো কাল্পনিক দূর ভবিষ্যৎ নয়- এটি এখন, এই মুহূর্তে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্র, শিল্প, প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক—সবারই সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এখনই যদি আমরা সকলে মিলে পদক্ষেপ নেই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারব। নইলে এই পৃথিবী থাকবে ঠিকই কিন্তু মানুষের ভবিষ্যৎ থাকবে গভীর অনিশ্চয়তার ছায়ায়।
জলবায়ু সংকটের ছায়ায় বিশ্ব অর্থনীতি-
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক ইস্যু নয়, এটি এখন বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি। ধনী রাষ্ট্রগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর নির্ভর করে উন্নত হয়েছে, অথচ এখন তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছ থেকে ‘সবুজ অর্থনীতি’ চায়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, অর্থ ও জ্ঞান এখনও তাদের হাতে সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তি হস্তান্তর ও জলবায়ু ন্যায্যতা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা অসম্ভব।
বিশ্বব্যাপী বেসরকারি খাতও এই সংকটে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে। মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলো যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে, তা অনেক দেশের মোট নিঃসরণের চেয়েও বেশি। কিন্তু তারা দায় এড়াতে নানা কৌশলে ‘কার্বন ক্রেডিট’ কিনে নেয়, অথচ বাস্তব পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়।
অপরদিকে, এই জলবায়ু সংকটের মধ্যে অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য দুর্বল রাষ্ট্রগুলো এখন নিজেদের জলবায়ু কূটনীতিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তারা কণ্ঠ তুলছে ‘Loss and Damage Fund’ বাস্তবায়নের পক্ষে। COP28 সম্মেলনে এই দাবিটি কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও বাস্তবায়নের গতির অভাব সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে।
দায় এখন সম্মিলিত-
জলবায়ু পরিবর্তন একটি গ্লোবাল এমারজেন্সি। এটি ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কূটনীতি পর্যন্ত সব কিছুকে প্রভাবিত করছে। জলবায়ুর সংকট কেবল আবহাওয়া বদলে দিচ্ছে না, এটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে, খাদ্য সংকট ডেকে আনছে, অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করছে এবং আমাদের প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
এই সংকট মোকাবেলায় দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আমরা যদি এখনই সাহসী সিদ্ধান্ত না নিই- জ্বালানি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার না করি, জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা না কমাই, প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধার না করি- তাহলে এই পৃথিবী আমাদের আর জায়গা করে দেবে না।
পরিবর্তনের সময় এখন। মানুষ যদি পারে যুদ্ধ থামাতে, মানুষই পারবে এই পৃথিবী রক্ষা করতে।