আধুনিক জীবনযাত্রায় প্রক্রিয়াজাত খাবার, বিশেষ করে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার খুবই জনপ্রিয়। এগুলো সহজলভ্য, স্বাদে ভালো এবং তুলনামূলক সস্তা। তবে গবেষণাগুলো বলছে, এই খাবারগুলো নিয়মিত বা অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে শরীরের ওপর পড়তে পারে ক্ষতিকর প্রভাব। এগুলো অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত করায় প্রাকৃতিক উপাদান কম থাকে। এতে থাকে সংরক্ষণকারী পদার্থ, কৃত্রিম রং ও স্বাদ, অতিরিক্ত চিনি, লবণ এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট। যেমন প্যাকেটজাত স্ন্যাকস, চিপস, সফট ড্রিংকস, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ধরনের খাবার খাওয়ার কারণে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকান জার্নাল অব প্রিভেনটিভ মেডিসিন’-এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটির জন্য আটটি দেশের প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করেন গবেষকেরা। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষকেরা দেখেন, খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিমাণ যত বাড়ছে, মৃত্যুঝুঁকিও তত বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বেশি পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাবার খান, তাঁদের ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। প্রতিদিন ৪ বারের বেশি এমন খাবার খেলে মৃত্যুর ঝুঁকি ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
প্রক্রিয়াজাত খাবার কী : প্রক্রিয়াজাত খাবার বলতে মূলত প্রাকৃতিক অবস্থায় না থাকা খাবারকে বোঝানো হয়। খাবার দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করতে কিছু পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেসব পদ্ধতির মধ্যে আছে খাবারের মূল উপাদানগুলো রোদে শুকানো ও আগুনে সেঁকে শুকনো করা বা সংরক্ষণকারী তরলে ডুবিয়ে রাখা এবং চিনি, লবণ, তেল, রং বা রাসায়নিক উপকরণে রান্না বা সংরক্ষণ করা। এগুলোর মধ্যে প্রথম দুই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা খাবারের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ইতিহাস পাওয়া যায় না তেমন। তৃতীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা খাবার শরীরের অবস্থার ওপর নির্ভর করে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে চিনি, লবণ, তেল, রং বা রাসায়নিক উপকরণে রান্না করা ও সংরক্ষিত খাবার। এ ধরনের খাবারের মধ্যে আছে ফাস্ট ফুড, মিষ্টি, বেকারি পণ্য, সসেজ, বেকন ইত্যাদির মতো প্রক্রিয়াজাত মাংস এবং চিনি, লবণ বা ফ্যাট যোগ করা খাবার। এসব খাবার দেখতে সুন্দর, খেতেও মজাদার। কিন্তু নিয়মিত খেলে শরীরের ক্ষতি হয়। কারণ, এসব খাবারে থাকে অতিরিক্ত চিনি, কৃত্রিম উপাদান, আঁশের ঘাটতি, ট্রান্স ফ্যাট। এসবে কোনো পুষ্টি থাকে না। আর এ ধরনের খাবারে ক্যালরি বেশি গ্রহণ করা হয়ে যায়।
অতিরিক্ত চিনি : অধিকাংশ প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত চিনি ও হাই-ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপ থাকে। এগুলো ওজন বাড়ায়, ইনসুলিনের ভারসাম্য নষ্ট করে ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। কোমল পানীয় বা কোলা জাতীয় পানীয়তে বেশি চিনি থাকে।
কৃত্রিম উপাদান : প্রক্রিয়াজাত খাবারে থাকা রং, ঘ্রাণ—সবই রাসায়নিকের তৈরি। আর্টিফিশিয়াল ফ্লেভার বা কৃত্রিম গন্ধ একাধিক রাসায়নিকের মিশ্রণে তৈরি, যার প্রকৃত উপাদান জানা যায় না।
পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট : প্রাকৃতিক শস্যের বদলে ব্যবহৃত হয় সাদা আটা, কর্ন ফ্লাওয়ার ইত্যাদি। এগুলো পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট। এগুলো খাওয়ার ফলে রক্তে চিনির মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়, যা হঠাৎ ক্ষুধা ও ক্লান্তির কারণ হতে পারে।
আঁশের ঘাটতি : আঁশ বা ফাইবার হজমে সাহায্য করে ও পেট ভরা রাখে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রাকৃতিক আঁশ প্রায় থাকে না বললেই চলে।
ট্রান্স ফ্যাট : প্রক্রিয়াজাত খাবারে হাইড্রোজেনযুক্ত তেল ব্যবহারে তৈরি হয় ট্রান্স ফ্যাট। এটি শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায়, ভালো কোলেস্টেরল কমায়। এ ছাড়া হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
পুষ্টির অভাব : এসব খাবারে ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খুবই কম থাকে। অনেক সময় কৃত্রিমভাবে কিছু ভিটামিন যোগ করা হয়। কিন্তু তা প্রকৃত খাবারের বিকল্প নয়।
দ্রুত ক্যালরি গ্রহণ : এ ধরনের খাবার চিবোতে এবং হজমে কম সময় লাগে। ফলে কম সময়ে বেশি খেয়ে ফেলা হয়। তাতে ক্যালরি, ওজন—দুটোই বাড়ে।
করণীয় কী : স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়তে হলে প্রক্রিয়াজাত খাবার যতটা সম্ভব কমাতে হবে। এ জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন, শাকসবজি ও ফলমূল, ডাল, বাদাম ও বীজ, শস্য, সেদ্ধ বা গ্রিল করা মাছ ও মুরগি আমরা যত সহজে ও মজা করে প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো খাই, ততটাই কঠিন এর পরিণাম। সাময়িক স্বাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে নিজেকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলবেন কি না, একবার ভাবুন। সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে