ব্যয়সংক্রান্ত বিল নিয়ে রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাট দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ব্যয় সংক্রান্ত বিল অনুমোদন না পাওয়ায় বুধবার (১ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রমে ‘শাটডাউন’ শুরু হয়েছে।
ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির আইনপ্রণেতারা গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থবরাদ্দ বিল নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম বন্ধ বা ‘শাটডাউন’ শুরু হয়েছে। বুধবার (১ অক্টোবর) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অচলাবস্থা কার্যকর হয়েছে।
তবে সরকারি ‘শাটডাউন’ শব্দটি পুরোপুরি সঠিক নয়। তহবিল শেষ হলেও সরকার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয় না। সামাজিক নিরাপত্তা চেক ও মেডিকেয়ার পেমেন্ট চলবে, কারণ এগুলো বার্ষিক তহবিল প্রক্রিয়ার বাইরে পড়ে। প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত থাকবে। সীমান্তরক্ষী তাদের কাজ চালিয়ে যাবে এবং ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসও কার্যক্রম চালু রাখবে। সেনা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত অধিকাংশ কার্যক্রমও সাধারণ সময়ের মতো চলবে।
দৈনন্দিন জীবনে কিছু অসুবিধা দেখা দিতে পারে। সরকারি কর্মচারীরা বেতন ছাড়াই কাজ করবেন বা সাময়িক ছুটিতে থাকবেন। সাধারণত শাটডাউন শেষে সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এমন কর্মচারীদের বরখাস্তের হুমকিও দিয়েছিল। সরকারি কার্যক্রম পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে আরও দক্ষ হতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক বিভাগ খোলা থাকলেও কাজের গতি কম থাকবে।
ট্রাম্পের সময় শেষ হওয়া সর্বশেষ শাটডাউন ছিল আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম। এটি সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল। সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তখন নিউ ইয়র্কের লা গার্ডিয়া বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, কারণ ১০ জন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার কাজে উপস্থিত ছিলেন না।
মার্কিন সরকারের তহবিল ঘাটতি বা ‘শাটডাউন’-এর ধারণা নতুন। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের অ্যাটর্নি জেনারেল বেঞ্জামিন সিভিলেত্তির এক আইনি স্মারক থেকে এর সূত্রপাত। এর আগে বাজেট অনুমোদন না হলেও সরকারি সংস্থাগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করত। মূলত একজন সরকারি আইনজীবীর লিখিত মতামত থেকেই শাটডাউনের ধারণার জন্ম।
নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ বরাদ্দ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা, কারণ অক্টোবরে নতুন অর্থবছর শুরু হয়। প্রতি বছর ১২টি পৃথক বরাদ্দ বিল পাস হওয়া প্রয়োজন। এ বছর একটিও বিল কংগ্রেসের দুই কক্ষ পেরোয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৯৭ অর্থবছরের পর থেকে কোনো বছরই সব বরাদ্দ বিল সেপ্টেম্বর ৩০-এর মধ্যে পাস হয়নি। কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে সাময়িক অর্থায়নের বিলের ওপর নির্ভর করছে। বর্তমান বিলও কেবল নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের কার্যক্রম চালাতে পারবে।
ডেমোক্র্যাটরা এটিকে সরকারের একমাত্র কার্যকর সুযোগ হিসেবে দেখছে। তারা জোর দিচ্ছেন, শেষ হতে থাকা ওবামাকেয়ার সহায়তা পুনর্বহাল হোক, যাতে প্রায় ২৪ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম বৃদ্ধির চাপ না পান। রিপাবলিকানরা চান, বিষয়টি বছরের শেষে আলাপের মাধ্যমে সমাধান হোক।
সরকারি তহবিল অবরোধ দীর্ঘ বা স্বল্পকালীন হতে পারে, কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে সমাধান হবে। বর্তমান অবরোধের সঙ্গে মিল আছে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়ের দুই স্বল্পকালীন তহবিল অবরোধের সঙ্গে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডেমোক্র্যাটরা ‘ড্রিমার’ শিশুদের স্থায়ী সাহায্য চেয়েছিলেন। সেই অস্থায়ী অবস্থান প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প সেই প্রোগ্রাম, ডিফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস (ডিএসিএ), শেষ করে দেন।
কয়েক দিনের মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা রাজি হয়ে তিন সপ্তাহের স্বল্পকালীন সরকারি তহবিল বিলের পক্ষে ভোট দেন, বিনিময়ে আশ্বাস পান যে ডিএসিএ নিয়ে আলোচনা ও সমাধানের সুযোগ পাবেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা সমাধান হয়নি।
রাজনীতিবিদরা শুধু মাথাব্যথা সৃষ্টি করেন না; দায়িত্বে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক মূল্যও দিতে হয়। সরকারি কার্যক্রম চালানোই তাদের মূল দায়িত্ব। বিশেষজ্ঞ ম্যাট গ্লাসম্যান বলেন, সাধারণত শাটডাউনকে ‘লাভের জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করা পার্টিই’ বেশি দোষী হয়। এই ক্ষেত্রে তা হতে পারে ডেমোক্র্যাটরা। যদি রাজনৈতিক মূল্য থাকে, তারা তা ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে দিতে পারেন, যখন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে আনতে মরিয়া। এর আগে তিনটি দীর্ঘমেয়াদি তহবিল জটিলতা দেখা দিয়েছে।
ক্লিনটন ও গিংরিচের শাটডাউন (নভেম্বর–ডিসেম্বর ১৯৯৫ ও জানুয়ারি ১৯৯৬)
সময়সীমা: প্রথমটি ৬ দিন, দ্বিতীয়টি ২২ দিন : ১৯৯৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন (মাঝে) হাউস স্পিকার নিউট গিংরিচ (বামে) এবং সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা বব ডলের সঙ্গে দেখা করেন। তারা তখন প্রতিযোগিতামূলক বাজেট নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদে এই শাতদাউন ২২ দিন স্থায়ী হয়। ফাইল ছবি: এপি
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রথমে পিছু হটেন, পরে কংগ্রেসের রিপাবলিকানরাও তাদের দাবি থেকে সরে আসেন। মোট ২৮ দিন শাটডাউন চলে। প্রথম শাটডাউনের শেষে ক্লিনটন বাজেট বাস্তবায়নে কিছু শর্ত মেনে নেন। দ্বিতীয় শাটডাউনে বাজেট নিয়ে রিপাবলিকানরাই পিছু হটেন। ৬ জানুয়ারি ১৯৯৬-এ শাটডাউন শেষ হলে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপাবলিকানদের পরাজয় হিসেবে চিত্রিত করেছিল। সম্পাদকীয়তে দলটিকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। টাইমসের প্রধান সম্পাদকীয়তে মাইকেল ওয়াইনস লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত শাটডাউন রিপাবলিকানদের বিপক্ষে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, যাদের দেখানো হয়েছিল তারা ফেডারেল কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর রাজনৈতিক সুবিধার জন্য হানাহানি চালাচ্ছে। যা আগে রাজনৈতিক দুর্বলতার চিহ্ন মনে হতো, ক্লিনটনের দৃঢ়তা হঠাৎ শত্রুর মোকাবেলায় সাহসের উদাহরণ হিসেবে প্রতীয়মান হলো।’
ওবামাকেয়ার শাটডাউন (অক্টোবর ২০১৩)
সময়সীমা: ১৬ দিন : রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা হাউসে স্বাস্থ্যসেবার তহবিল বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট ওবামা দায়িত্বে ছিলেন এবং সেনেটে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকানরা সরকারকে চলতি বাজেট অনুযায়ী অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। হাউস স্পিকার জন বোয়নার এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন, ‘আমরা ভালো লড়াই করেছি। কিন্তু আমরা জিততে পারিনি।’
ট্রাম্পের শাটডাউন (ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে জানুয়ারি ২০১৯)
সময়সীমা: ৩৫ দিন : ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সবচেয়ে দীর্ঘ সরকারি শাটডাউন হয়। নির্বাচনের পর রিপাবলিকানরা হাউসের নিয়ন্ত্রণ হারায়, ডেমোক্র্যাটরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ নেননি। সীমান্ত প্রাচীরের জন্য অর্থ চেয়ে ট্রাম্প হুমকি দেন, যদি বিলের মধ্যে প্রাচীরের অর্থ না থাকে, তিনি স্বাক্ষর করবেন না। হাউস ও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তহবিল ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। পরে ডেমোক্র্যাটরা জোর দেন, সীমান্ত প্রাচীর নিয়ে বিতর্ক বড় ব্যয়-সংক্রান্ত বিল থেকে আলাদা হতে হবে। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প পিছু হটেন, কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ শাটডাউন ঘটে। বর্তমান পরিস্থিতিও তখনকার মতোই, যখন রিপাবলিকানরা কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল।