২৬শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ট্রাম্প শুল্ক: উচ্ছ্বাসের বদলে হোক সতর্ক পর্যালোচনা

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মাঝে যে ঝুঁকিতে আমরা পড়েছিলাম, তা থেকে রেহাই পাওয়ার খবরে স্বস্তি মিলেছে। এটা ‘আপাত স্বস্তি’ কিনা, সেটা অবশ্য বোঝা যাবে এ-সংক্রান্ত চুক্তি হলে এবং আওতাভুক্ত অন্যান্য বিষয় জানা গেলে। গড়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ শুল্ক মিটিয়েই তৈরি পোশাকের ওই বৃহত্তম বাজারে আমরা ঢুকতাম। মাঝে কোন বিবেচনায় ট্রাম্প প্রশাসন নতুন ৩৭ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছিল, সে প্রশ্ন তুলে অবশ্য লাভ নেই। দীর্ঘদিনের বহুমাত্রিক মিত্রদের সঙ্গেও দেশটি ‘সদাচরণ’ করেনি। পরে আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্কও ছিল বিপজ্জনক। এ অবস্থায় সুবিধাজনক শুল্ক সুবিধা আদায়ে নিকট প্রতিযোগীরা এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এগোতে না পারায় বাড়ছিল উদ্বেগ। অবশেষে নতুন শুল্ক কার্যকরের আগমুহূর্তে মিলল ১৫ শতাংশ শুল্ক হ্রাসের খবর। এটাকে ‘ঐতিহাসিক’ না বলতে চাইলেও উৎসাহব্যঞ্জক বলা যায়। সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তাদের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায়, তারা আশ্বস্ত।

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাইরে তেমন কিছু রপ্তানি করি না, যেটা আমাদের নিকটতম প্রতিযোগী যেমন চীন ও ভিয়েতনাম করে। সে কারণে নতুন শুল্ক আরোপের এ ঘটনায় আমাদের অন্যান্য রপ্তানি পণ্য উৎপাদকদের প্রতিক্রিয়া তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চামড়াজাত পণ্যসহ কিছু খাতের রপ্তানি সম্ভাবনাকে কিন্তু খাটো করে দেখা যাবে না। তবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রাখতেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এমনকি সচেষ্ট হতে হবে সেখানে এর রপ্তানি বাড়াতেও। নিকটতম প্রতিযোগীদের ওপর প্রায় সমান শুল্ক আরোপের ঘটনায় আমাদের বাজার হারানোর শঙ্কা অবশ্য দূর হয়েছে। চীন, ভারতের মতো প্রতিযোগীর ওপর পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ অধিক শুল্ক আরোপের খবরে এ আশাবাদও জেগেছে, তাদের কাছ থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে চলে আসবে। বাড়তি ক্রয়াদেশ অনুযায়ী পণ্য তৈরির সক্ষমতাও আমাদের আছে। এ খাতে রয়েছে আমাদের উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে চার দশকের অভিজ্ঞতা। এর সবই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জানা।

চীন, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আলোচনায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি অবশ্য। চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক জটিল। শুরুতে তো ধারণা ছিল, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকায় ট্রাম্প প্রশাসন মূলত চীনের ওপরেই বড়মাপের শুল্ক বসাবে। এর বদলে কী ঘটেছে, আমরা জানি। ‘দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত মিত্র’ ভারতকেও খাতির করছে না; এখন পর্যন্ত আরোপিত নতুন শুল্ক ২৫ শতাংশ। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের চলমান বাণিজ্য, বিশেষত জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বিরক্তি গোপন করেননি। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বাইডেন প্রশাসন আরোপিত নিষেধাজ্ঞায়ও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রেখেছিল ভারত। কম দামের কারণেই সুযোগটি হাতছাড়া করেনি। যুক্তরাষ্ট্রও ভুলে যায়নি সেটা। এ অবস্থায় ভারত তার বাণিজ্যনীতিতে বড় ছাড় দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মন গলাতে পারবে কিনা, কে জানে! দেশটির ওপর শুল্ক আরও বাড়তে পারে বলে জল্পনা রয়েছে। সেটি ঘটলে আমাদের জন্য ভালো। আর চীন থেকে শুধু ক্রয়াদেশ নয়; বস্ত্র খাতের কিছু বিনিয়োগও এখানে চলে আসার সম্ভাবনা। দেশটি এমনিতেও এসব খাতে মনোযোগ কমিয়ে ব্যবসার অন্য দিগন্তে ছুটছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাজার হারানোর শঙ্কার বদলে আমরা এখন সেখানে আরও বেশি হিস্যা লাভের আলাপ করতে পারছি; এটা আনন্দের। নতুন শুল্কের বড় আঘাতে বাজার হারালে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলো সাক্ষাৎ বিপদে পড়ে যেত। দ্রুত অন্যত্র বাজার খুঁজে নিয়ে ব্যবসা ধরে রাখা তো কঠিন। সে ক্ষেত্রে ইইউভুক্ত দেশগুলোয় বাড়ত বাজার ধরার প্রতিযোগিতা। উৎপাদকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়লে ক্রেতারা দাম কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ নিয়ে থাকেন। তখন কম মুনাফায়, এমনকি লোকসানে কারখানা চালু রাখতে বাধ্য হন অনেক উদ্যোক্তা। দীর্ঘদিনের ব্যবসা থেকে চট করে সরে যাওয়ার সুযোগ কমই। নতুন সুযোগের প্রত্যাশায়ও থাকেন অনেকে।

বেদনাদায়ক এ প্রক্রিয়ায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে রেহাই পেয়েছেন আমাদের উদ্যোক্তারা। ৩৫ শতাংশ নতুন শুল্ক বহাল থাকলে ১০ লাখের মতো শ্রমিক কর্মচ্যুতির ঝুঁকিতে পড়ত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে সরকারের টিম অন্তিম মুহূর্তে হলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক ধরনের সুখবর দিতে পেরেছে।

চুক্তি সইয়ের আগ পর্যন্ত অবশ্য জানার সুযোগ নেই, ঠিক কোন কোন শর্তে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছাড় আদায় করা গেছে কঠোর বাণিজ্য-বুদ্ধিসম্পন্ন ট্রাম্প প্রশাসন থেকে। বাণিজ্য-বহির্ভূত (নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক) বিষয়াদিও এর আওতাধীন বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুল্ক আলোচনায় ‘গোপনীয়তা রক্ষা’-সংক্রান্ত সমঝোতায় যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় সেসব প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টাও শুরু থেকে এ আলোচনায় আছেন। সে কারণেও মনে করা হচ্ছে, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়ে আশ্বস্ত করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ার শর্ত নাকি রয়েছে। বাণিজ্যেও যেসব শর্ত আরোপের কথা শোনা যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চলমান কাঠামোর সঙ্গে বেমানান। প্রশ্ন হলো, অন্যান্য দেশও কি এসব শর্ত মেনে শুল্ক চুক্তিতে উপনীত হয়েছে? অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী বলে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের মতো দেশ তাহলে কীভাবে ‘ম্যানেজ’ করছে– সে প্রশ্ন উঠছে স্বভাবতই।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, তাদের করা চুক্তিতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু থাকলে নির্বাচিত সরকার সেটা পুনর্বিবেচনা করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চয় কঠিন। তুলা, গম, স্ক্র‍্যাপ, সয়াবিন, এলএনজি প্রভৃতির আমদানি বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও সহজ নয়। তাদের তুলা দিয়ে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশটিতে শুল্ক ছাড় মেলার সম্ভাবনায় অবশ্য এর আমদানি বাড়তে পারে অনেকটাই। এ ক্ষেত্রেও ‘কস্ট-বেনিফিট’ হিসাবায়নের প্রশ্ন রয়েছে। ২৫টি বোয়িং আমদানিও শিগগির হচ্ছে না। দ্রুত চুক্তি করে গম আনলেও বেশি দামে আনতে হবে। আমদানি করবে তো মূলত বেসরকারি খাত। অধিক পরিবহন ব্যয় আর সময়ও এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। এসব দিক যুক্তরাষ্ট্রেরও অজানা নয় বলে তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে ‘অন্যান্য সুবিধা’ আদায়ে ব্যগ্র হতে পারে। এ অবস্থায় চুক্তির বিস্তারিত জানার আগ্রহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও থাকবে। সে পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত হওয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

দৃষ্টি বরং নিবদ্ধ রাখতে হবে বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে এবং সম্পৃক্ত ক্ষেত্রগুলোয় উদ্যোক্তাদের ঝক্কি-ঝামেলা হ্রাসে। জ্বালানি, পরিবহন, বন্দরসহ ব্যবসার সার্বিক সুবিধা যেন বাড়ে। নইলে শুধু শুল্ক সুবিধায় রপ্তানি বাড়ানো কঠিন। অভিন্ন সুবিধা তো নিকটতম প্রতিযোগীরাও পাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, তুরস্কের মতো উঠে আসতে থাকা প্রতিযোগীর দিকেও দৃষ্টি রাখা চাই। নতুন ও সম্ভাবনাময় বাজারে হিস্যা বাড়ানো এবং অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে জোর দেওয়াও জরুরি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক আরও কিছুটা কমানোর প্রয়াসও জারি রাখা চাই। বেসরকারি খাতও এ লক্ষ্যে অব্যাহত রাখুক দৌড়ঝাঁপ। হাসান মামুন সাংবাদিক, কলাম লেখক। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে