২৫শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অর্থনীতি

বৈশ্বিক অংশীদারত্বে ২০ মিলিয়ন ডলারের লাইফলাইন, বেক্সিমকোর বন্ধ ১৫ কারখানা চালু হবে ডিসেম্বরে

বৈশ্বিক অংশীদারত্বে ২০ মিলিয়ন ডলারের লাইফলাইন, বেক্সিমকোর বন্ধ ১৫ কারখানা চালু হবে ডিসেম্বরে

দীর্ঘ ৯ মাস বন্ধ থাকার পর আবারও চালু হতে যাচ্ছে বেক্সিমকো টেক্সটাইলসভুক্ত ১৫টি কারখানা। এজন্য বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের বড় ঋণদাতা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, জাপানী কোম্পানি রিভাইভাল গ্রুপ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইকোমিলির যৌথ উদ্যোগ এবং বেক্সিমকো গ্রুপের মধ্যে আগামী সপ্তাহে লিজ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, আগামী মঙ্গলবার চুক্তির খসড়া জনতা ব্যাংকের বোর্ডে অনুমোদনের পর এই চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর শ্রম উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি চুক্তিটি অনুমোদনের পর কারখানাগুলো চালু হবে।

প্রাথমিকভাবে রিভাইভাল ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে, যার যোগান দেবে ইকোমিলি। কর্মকর্তারা বলছেন, এতে ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক তাঁদের কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন।

এর আগে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের বন্ধ কারখানাগুলো চালু করতে এই তিন পক্ষের মধ্যে গত ৮ অক্টোবর একটি চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করে। এর মধ্যে রিভাইভাল ও ইকোমিলি মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের কোম্পানি, ‍যাদের বড় অংশই বুয়েট থেকে পাস করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছেন।

বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত জনতা ব্যাংকসহ অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সব ঋণ এখনো শ্রেণিকৃত ঋণ হিসেবে রয়েছে।

চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, বেক্সিমকো টেক্সটাইলের ১৫টি কারখানার বকেয়া ঋণের কোন দায়ভার নেবে না রিভাইভাল। আর কারখানাগুলো চালু করতে নতুন করে কোন ঋণ সুবিধা দেবে না জনতা ব্যাংক। বন্ধ কারখানা চালু করতে যে পরিমাণ চলতি মূলধন লাগবে, তার জোগান দেবে রিভাইভাল এবং কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পোশাক ও ফেব্রিক রপ্তানি আয়ের ১.৫% থেকে ২.৫% সার্ভিজ চার্জ হিসেবে নেবে কোম্পানিটি। প্রাথমিকভাবে ২ বছর ৪ মাসের জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে পক্ষগুলো, পরবর্তীতে এর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকছে চুক্তিতে।

রপ্তানি আয়ের বাকি অংশ থেকে শ্রমিকদের মজুরি, ট্যাক্সসহ সব ধরণের পরিচালন ব্যয় মেটানোর পর যে নিট মুনাফা হবে, তা পাবে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি এই অর্থ দিয়ে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কাছে পুরনো ঋণ সমন্বয় করার পাশাপাশি কারখানাগুলো বন্ধ করার সময় তাদের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে সরকার যে ৫৮৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, তাও পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করবে জনতা ব্যাংক।
কারখানা চালুর পর রপ্তানি থেকে যে মুনাফা হবে, সেখান থেকে কোন টাকা পাবে না বেক্সিমকো গ্রুপ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ–বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন টিবিএসকে বলেন, বেক্সিমকো টেক্সটাইলসভুক্ত কারখানাগুলো চালুর বিষয়ে মূলত কাজ করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক।

রিভাইভালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা হুদা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ‘এটা শুধু কারখানা চালু করা নয়—হাজারো পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। প্রতিটি ফিরে আসা চাকরি নতুন করে আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবে।’

ইকোমিলির প্রেসিডেন্ট ড. ফারহান এস. করিম বলেন, ‘এটি ব্রেইন ড্রেইনের গল্প নয়—এটি ব্রেইন গেইনের গল্প। প্রবাসীদের দক্ষতা কীভাবে দেশের শিল্পখাতকে শক্তিশালী করে এটি তারও উদাহরণ। আমরা একসঙ্গে মানুষের জীবিকা ফেরানোর পাশাপাশি দেশের শিল্পখাতকে নতুন প্রাণ দিতে চাই।’

বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের নির্দেশে বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত আমাদের টেক্সটাইল বিভাগ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ চালিয়ে গেছে। ৪২ হাজার কর্মী ও কর্মকর্তার চাকরি ও রপ্তানি রক্ষা করা ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আর্থিক সংকটের মধ্যেও আমরা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো সচল রেখেছি যাতে যেকোনো মুহূর্তে কারখানা চালু করা যায়। রিভাইভালের উদ্যোগে সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে।’

৫ আগস্টের পর বেক্সিমকোর সংকট : গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অক্টোবর থেকেই বেতন-ভাতা বকেয়া পরে বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের কারখানাগুলোর। অন্তর্বর্তী সরকারও ব্যাপক আইনি পদক্ষেপ নেয়—যার মধ্যে ছিল ব্যাংক হিসাব জব্দ, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অর্থপাচার ও ঋণ খেলাপি মামলার কার্যক্রম।

শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে গত ফেব্রুয়ারিতে শ্রমিকদের দেনা-পাওনা সরকারের পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দিয়ে কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের তহবিল থেকে বেক্সিমকোর নামে ৫৮৫ কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণ দেয় সরকার।

বেক্সিমকো টেক্সটাইলসভুক্ত মোট কারখানার সংখ্যা ৩১টি। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। বন্ধ হওয়ার আগে ১৫টি কারাখানা চালু ছিল বলে জানিয়েছেন বেক্সিমকোর কর্মকর্তারা। নতুন চুক্তিটি চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর এসব কারখানা আবারো চালু করা হবে।

বেক্সিমকো লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৮৯৮.২৮ কোটি টাকা। এই কোম্পানিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারিখাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মোট শেয়ারের হার ৭.৮৯ শতাংশ।

বেক্সিমকো লিমিটেড বাদে অন্য ১৪টি কারখানার মধ্যে শুধু ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার এন্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডে সালমান এফ রহমানের মালিকানা রয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য কোন কারখানায় তার কোন মালিকানা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

‘২০২৫ সালের ডিসেম্বরেই পুনরায় উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য’ : শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রথম ধাপে রিভাইভাল ও ইকোমিলি ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সহায়তা দেবে এবং প্রয়োজনে তা ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হবে। রিভাইভাল ও ইকোমিলির শীর্ষ কর্মকর্তারা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে উৎপাদন শুরু হলে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কারখানাগুলোতে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক আবার কাজে ফিরতে পারবে বলে জানান তিনি। রিভাইভাল আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারবে, যা বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং শিল্পটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

তিনি জানান, বেক্সিমকোর পুরোনো কোনো ঋণের দায়ভার নেবে না রিভাইভাল। বেক্সিমকোর ঋণ আপাতত ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখবে জনতা ব্যাংক, যাতে আর বাড়তি সুদ যুক্ত না হয়। মঙ্গলবার জনতা ব্যাংকের বোর্ডে একই সঙ্গে চুক্তির খসড়া ও বেক্সিমকো ঋণ ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বেক্সিমকো টেক্সটাইল চালু করার কথা সরকার বিবেচনা করেছে, কারণ এই গ্রুপটির কারখানাগুলোতে উন্নতমানের মেশিন রয়েছে। পাশাপাশি তাদের রয়েছে বৈশ্বিক ক্রেতাও। ফলে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে সরকার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি চালু করার উদ্যোগ নেয়। তারই অংশ হিসেবে জাপানি কোম্পানি রিভাইভালের সাথে আলোচনা করা হয়।

‘লিজ চুক্তির মাধ্যমে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার বিষয়টি সমন্বয় করছে শ্রম মন্ত্রণালয়, যা গত ২২ জুলাই শ্রম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় অনুমোদন করা হয়। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেড ও বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন’- তিনি যোগ করেন।

বেক্সিমকো গ্রুপের একজন ঊধর্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার আগে বেক্সিমকো যেসব বিদেশি ক্রেতার কাছে পোশাক রপ্তানি করতো, সেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে রপ্তানি করা হলে রিভাইভাল সার্ভিজ চার্জ হিসেবে মোট রপ্তানি মূল্যের ১.৫ শতাংশ কমিশন পাবে। তবে রিভাইভাল নতুন কোন ব্রান্ডের কাছে রপ্তানি করতে পারলে, সেক্ষেত্রে তাদের সার্ভিস চার্জের পরিমাণ বেড়ে ২.৫ শতাংশ হবে।

শ্রম মন্ত্রণালয় হিসাব করে দেখেছে যে, পোশাক বা টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কর-ভ্যাট, ঋণের সুদসহ সব ধরণের পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে ৪.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ নিট মুনাফা করে থাকে।

কারখানা চালুর পাশাপাশি রিভাইভাল বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে চায় রিভাইভাল। তারা বেক্সিমকোর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপন করবে এবং নতুন বৈশ্বিক অংশীদারও যুক্ত করবে। শুধু কম খরচে পোশাক উৎপাদন নয়, বরং বাংলাদেশকে সৃজনশীলতা ও ব্র্যান্ড উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।

রিভাইভালের দর্শন— ‘স্থানীয় ডিজাইন, বৈশ্বিক বাজার’ (লোকালি ডিজাইন, সেল গ্লোবালি)—বাংলাদেশি পণ্যে নতুন উচ্চমান যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। – টিবিএস