টানা চার দিন ধরে দাবানলে জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহর। শত চেষ্টার পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না আগুন। পুড়ে ছারখার হচ্ছে এলাকার পর এলাকা। আগুনে এখন পর্যন্ত দেড় শ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মানুষের প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। এই পরিস্থিতির মধ্যে লুটপাটও চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। লুটপাট ঠেকাতে একটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির শেরিফ রবার্ট লুনা দাবানলের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেছেন, মনে হচ্ছে এই এলাকাগুলোয় একটি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছানো এখনো অনিরাপদ হওয়ায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
একাধিক সংবাদমাধ্যমেরপ্রতিবেদন অনুযায়ী, দাবানল থেকে আনুমানিক ১৮০ থেকে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে । এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। লস অ্যাঞ্জেলেসে আগুনের সূত্রপাত হয় গত মঙ্গলবার ৭ জানুয়ারী। গত বৃহস্পতিবার ৯ জানুয়ারীরাত পর্যন্ত পাঁচটি স্থানে দাবানল সক্রিয়ভাবে জ্বলছিল। এর মধ্যে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের পশ্চিম দিকে সান্তা মনিকা ও মালিবু এলাকার মাঝে এবং পূর্ব দিকে পাসাডেনা এলাকার কাছের দাবানল দুটি সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের কারণ হয়েছে। এই দুই দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৩৪ হাজার একর জায়গার গাছপালা, ঘরবাড়িসহ সবকিছু।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ছয়টি আলাদা দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে তিনটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিস্থিতির অবনতির কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রায় ১ লাখ ৭৯ হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে তৈরি করা হয়েছে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র।
এদিকে শহরের হলিউড হিল এলাকার আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দাবানলের ভয়ে সেখান থেকে সরে যাওয়া অনেক মানুষ নিজেদের বাড়িতে ফিরছেন। অভিজাত প্যাসিফিক প্যালিসেইডস এলাকায় পুড়ে ছাই হওয়া ঘরবাড়িগুলোতেও লোকজনকে ফিরতে দেখা গেছে। এমনই একজন বিলাল তুখি। তিনি বলেন, আগুনে পোড়া এলাকাটি তাঁকে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই এলাকারই আরেক বাসিন্দা জন কার (৬৫)। প্রাণ বাঁচাতে এলাকা ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়ার পরও তিনি নিজ বাড়িতে থেকে যান। জন কার বলেন, বাড়িটি তাঁর মা–বাবা ১৯৬০ সালে নির্মাণ করেছিলেন। অনেক স্মৃতি থাকায় বাড়িটি ছেড়ে যাননি তিনি। তাঁর অভিযোগ, প্রতিবেশীদের ঘরবাড়িগুলো আগুন থেকে বাঁচাতে ফায়ার সার্ভিসের কোনোরকম সহায়তা পাননি তিনি।
যদিও লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র কারেন বাস বলেছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর শহর পুনর্নির্মাণে জোর তৎপরতা শুরু করবেন তাঁরা। আর আজ শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এই আগুন নেভাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসের গভর্নর ও স্থানীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারী) পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এ সময় আরও বাড়ানো হতে পারে। এ দাবানলকে ইতিমধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। উদ্ধার ও পুনর্বাসনে কাজ করছে প্রশাসন ও জরুরি সেবা সংস্থাগুলো।
সর্বোচ্চ সতর্কতা, কারফিউ জারি
দাবানল ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ ঝোড়ো বাতাস। আগুনের শুরুর দিকে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের গতি উঠছিল। তবে বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারী) তা কমে এসেছে। ১০ জানুয়ারী শুক্রবার তা আরও কমে আসার কথা। তবে বাতাস পুরোপুরি না থামায় এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা না থাকায় শুক্রবার পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেস ও ক্যালিফোর্নিয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি রাখা হয়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের বিভিন্ন প্রান্তে আগুন নেভাতে দিন-রাত কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বিভিন্ন স্থানে উড়োজাহাজ থেকে পানি ফেলতে দেখা গেছে। তবে তেমন অগ্রগতি পাওয়া যায়নি। গতকাল সকালে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুনের মাত্র ৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে তারা।
দাবানলের কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে। সেখানে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত স্কুল–কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া মানুষের দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে বাড়িঘরে লুটপাটও চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সান্তা মনিকা এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।