বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও গত বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশেরও কম। অন্যদিকে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের বেশি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেশটির বাজারে ভিয়েতনামের পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের জন্য এ হার ৩৫ শতাংশ। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শুল্কহারে ছাড় না পেলে তৈরি পোশাক রফতানিতে ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে ১৬৫ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানির মাধ্যমে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটির তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ এ সময়ে ৩৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ২১ শতাংশ। তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিযোগী ভিয়েতনাম গত বছরে ৩৩ দশমিক ৯৪ ডলার রফতানি করেছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অন্য প্রতিযোগীদের মধ্যে গত বছর শুধু তুরস্কের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ সময়ে ভারত, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে ভারত ১৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। দেশটির রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। কম্বোডিয়া ২০২৪ সালে ৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। এক্ষেত্রে দেশটির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। পাকিস্তান এ সময়ে তৈরি পোশাক রফতানিতে ২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দেশটির রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ইন্দোনেশিয়া গত বছর ৮ দশমিক ৭৩ ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। এক্ষেত্রে দেশটির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে চীনের হিস্যার পরিমাণ ২০২৪ সাল শেষে ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর আগের বছরে যা ছিল ৩১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ হিস্যা থাকলেও গত বছর এটি কমে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ভিয়েতনাম এরই মধ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক হার নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মাত্র ৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রধান প্রতিযোগী দেশ চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে শুল্কের হার কেমন হয় সেটি দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানি গন্তব্য হওয়ায় এ শুল্কের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেবল রফতানি আদেশ হ্রাসের ঝুঁকি নয়, এর প্রভাব কর্মসংস্থান হ্রাস ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কেবল বাণিজ্যেই নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।’
বাংলাদেশের রফতানিতে কম প্রবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডব্লিউটিওর সঙ্গে আমাদের তথ্যের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের হিসাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে রফতানিতে ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে গত দুই-তিন বছর বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে এ সময়ে কিছুটা প্রভাব তো পড়েছেই।’
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক বৈশ্বিকভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি ও বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক ছাড় কিংবা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ চারটি। চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান। এরই মধ্যে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আলোচনা চললেও এখনো পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। চীনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব এখন পর্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ফলে দেশটি শুল্কের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। পাকিস্তানের ওপর শুল্কের হার বাংলাদেশের কাছাকাছি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। বাংলাদেশের জন্য এক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া কম্বোডিয়ার পণ্যের ওপর ৩৬ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কিন শুল্কের কারণে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলে সেক্ষেত্রে দেশটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ক্রয়াদেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলে তারা বাংলাদেশের বাকি ৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশের ওপর প্রভাব ফেলার ক্ষেত্র তৈরি হবে। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানির ব্যবধান খুব বেশি না হওয়ায় দেশটি তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে শুল্কের পরিমাণ কমানো সম্ভব না হলে সেটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক ১০০ শতাংশ আরোপ করা হলেও কিছু যায় আসবে না; যদি চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ওপর আরোপ করা শুল্কহার বেশি বা কাছাকাছি থাকে। আমি বাংলাদেশের ওপর কত শুল্ক আরোপ হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে চিন্তিত না। চিন্তিত প্রতিযোগী দেশগুলোর ক্ষেত্রে শুল্কহার কী বসতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ চারটি—চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান। এর মধ্যে যেকোনো একটি দেশের ওপর বাংলাদেশের চেয়ে কম হারে শুল্ক আরোপ হলে সেটা বড় কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। কিন্তু তিনটি দেশের যদি বাংলাদেশের চেয়ে শুল্কহার কম হয় সেটা বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় হতে পারে।’